কালরাতের কঠিন চিত্র

গণহত্যা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মোহাম্মদ ইমরান
গণহত্যা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মোহাম্মদ ইমরান

ব্যানার টানানো রয়েছে। সেখানে লেখা—গণহত্যা দিবস। গা ছমছম করা অনুভূতি। যাঁরা একাত্তর দেখেছেন তাঁরা আবার সেই জায়গায় ফিরে যান। অন্তরলোকে হাতড়ান অন্য এক মুহূর্তকে। যাঁরা শুনেছেন তাঁদেরও মনের মধ্যে ভয় ভয় ভাব। পাশে সাদা একটি পর্দা। এতে প্রদর্শিত হবে একাত্তরের ২৫ মার্চের চিত্র। দর্শকের সারিতে এক এক করে বসছেন সবাই। 

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির বাংলাদেশ দূতাবাসের কনফারেন্স হল। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করে অনুষ্ঠানটি শুরু করা হয়। বলা হয় পৃথিবীর নারকীয় পাঁচ ঘটনার একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে ঢাকা নগরীর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। আয়োজনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী পড়া হয়। বাণী পড়েন কাউন্সেলর ও দূতাবাস মিনিস্টার মো. ইকবাল হোসেন খান, কাউন্সেলর ও চ্যান্সারি প্রধান মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ফারুকী। সভা সঞ্চালনা করেন কাউন্সেলর আরমান উল্লা চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে মুস্তাফা মাসুদ লিখিত ও আবদুল্লাহ আল হারুন পরিচালিত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের ভয়াল গর্জনে রাত ১২টার পর পুরো নগরীই জাহান্নামে পরিণত হয়। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুরু করে ইতিহাসের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। শুরু হয় বাঙালি নিধনে গণহত্যা। তারা হত্যাকাণ্ড চালায়, অগ্নিসংযোগ করে। অত্যাচার থেকে নারী শিশু কেউ রক্ষা পায়নি। এই নৃশংসতা চলে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।

রাষ্ট্রপতির বাণী পাঠ করেন মো. ইকবাল হোসেন খান
রাষ্ট্রপতির বাণী পাঠ করেন মো. ইকবাল হোসেন খান

মীর আনিসুল হাসান স্বাগত বক্তব্য দেন। একাত্তরের মার্চে জামালপুর জ্বলতে থাকে, ব্রহ্মপুত্রে ভাসে মরদেহ, মানুষ ছোটে দিগ্‌বিদিক। তিনি তাঁর দেখা এমন এক সময়কে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ কবিতা লেখেন। যেখানে পা সেখানে রক্ত। মানুষ এগোনোর রাস্তা পায় না। যুদ্ধের বীভৎসতা উঠে এসেছে এতে।
নাড়ি-ভুঁড়ি পেটের মধ্যে গুঁজে হাসপাতালে যায় একজন। পরে কলকাতা। প্রতি এলাকা হয়ে যায় জল্লাদখানা। এগুলো দেখা ঘটনা। তিনি বলেন, এসব নিয়ে দেশি বিদেশি লেখক ও ভাষ্যকারেরা অনেক লিখেছেন। এগুলো পড়লে ওদের নারকীয় কর্ম সম্পর্কে প্রজন্ম জানবে। তিনি এসব পড়ার আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ফারুকী
প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করেন মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ফারুকী


জনতা ব্যাংকের নির্বাহী প্রধান মো. আমিরুল হাসান এ হত্যাকাণ্ডকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, খাটের নিচে সারা রাত আত্মগোপনে থাকার পর নিরাপদ স্থান খোঁজা, এ বড় কষ্টকর অভিজ্ঞতা।
বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় শাখার প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেন, ২৫ মার্চের কালরাতের আক্রমণের মধ্য দিয়ে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে এসব পাপকর্মে তাদের সাহায্য করে বাঙালি রাজাকার, আল বদর, আল শামস। বলা হয়, পাকিস্তানিরা যে হাড়ে হাড়ে বর্বর তা তাদের আচরণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট।
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান প্রামাণ্যচিত্রের সূত্র উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, একটা জাতি গোষ্ঠীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানিদের এই গণহত্যা। গত শতাব্দীতে এমন ঘটনা কমই ঘটেছে। আবার এই বর্বরতাকে সামনে আনার দৃশ্যমান চেষ্টাও ছিল না। তখন ইতিহাসকে ভিন্নভাবে নেওয়ার প্রয়াস চলে। তবে প্রেক্ষাপট বদলেছে। গণহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির গুরুত্ব বেড়েছে। এখন ২৫ মার্চের কালরাতকে আন্তর্জাতিকভাবে পালন করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিদের অপরাধ বা পাপ প্রকাশ পাবে।
কালরাতেরই সময়কাল। এরপর কারফিউ শিথিল করা হয়। দলে দলে মানুষ বুড়িগঙ্গা পার হয়। সেখানেও হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। তবে এর বিপরীতে চলে প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। তিনি এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের শহর ময়মনসিংহের উদাহরণ তুলে ধরেন।
ব্রহ্মপুত্র নদের চরে লাশ পড়ে আছে। কুকুরে টানাটানি করছে। শকুনে খাচ্ছে, দড়িতে বেঁধে সেসব আনা হচ্ছে। এসবই ইতিহাস। এসব যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কাছ থেকে দৃশ্যের আসল বর্ণনা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের অনেকেই এখন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বাদ যায় না। সত্তরের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পায় আওয়ামী লীগ। ৩০০ আসন সারা পাকিস্তানে। তাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাহানা শুরু করে। একদিকে বলে আলোচনায় বসা হচ্ছে অন্যদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টো মিলে হত্যার নীলনকশা করে। কট্টরপন্থীদের যুক্ত করা হয় ক্ষমতার মূল মূল জায়গায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা রাও ফরমান আলীর বই পড়লেও এসব জানা যাবে।

আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মীর আনিসুল হাসান
আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মীর আনিসুল হাসান


রাজারবাগ আক্রমণ করে হত্যা করা হয় শত শত পুলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো হলো। বঙ্গবন্ধু এসব আঁচ করতে পেরেছিলেন বলে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভালো কিছু অর্জনের পেছনে থাকে ত্যাগ। সেসবের জন্যই গর্ব। আজ আমরা বুক ফুলিয়ে গৌরবগাথা বলতে পারি। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান যোগ করেন, বহুমূল্যে কেনা বাঙালির স্বাধীনতা সে কারণে মর্যাদাবান, ঐশ্বর্যবান।
প্রামাণ্যচিত্র। ভোটের ব্যালট বাক্স। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। এসব ধারাবাহিকতা। এরই মধ্য দিয়ে কামরুল হাসান অঙ্কিত ইয়াহিয়ার ভয়াবহ মুখ। জ্বলছে বাংলা। মৃতদেহ। তার মধ্য দিয়ে পতাকা ওড়ে। লাখ লাখ জীবন উৎসর্গ করা হয়। শহীদের তালিকা দেখানো হয়। বিশ্বের নারকীয় পাঁচ ঘটনার মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড একটি। নদী, পাহাড়, সমতল—কোনো একটি জায়গা রক্ষা পায়নি। 

আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মো. আমিরুল হাসান
আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মো. আমিরুল হাসান


হাড় গোড় খুলি। রায়ের বাজার বধ্যভূমি। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা। বিভিন্ন জেলার চিত্র দেখানো হয়। পাহাড়তলি, কালুরঘাট। মরদেহ, কঙ্কাল। ব্রহ্মপুত্রের পাড়। চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ী, বেতিয়ারা, রাজশাহী, বকচর, বরিশাল, কীর্তনখোলা, বাগেরহাট, বগুড়া, দিনাজপুর সর্বত্র। গোটা বাংলা হয়ে যায় মৃত্যু উপত্যকা।
ধারা বিবরণীতে বলা হয়, তারা মরেনি। জীবন উৎসর্গ করে হয়েছেন অমর। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর জেগে ওঠে সামনে। দাঁড়িয়ে স্মৃতিসৌধ।
এরপর বক্তব্য। পাকিস্তানিদের প্রতি এক ধরনের ঘেন্না তাঁদের মনে। তাঁরা তা আঁটকে রাখতে পারলেন না। প্রকাশ করলেন। নিজের জানাকে শাণিত করলেন। ইস্পাতসম দৃঢ়তায় নিজেকে প্রস্তুত করার ঘোষণা দিলেন।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত