ব্রাজিলে গণহত্যা ও স্বাধীনতা দিবস

গণহত্যা দিবসে আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য দেন মো. জুলফিকার রহমান
গণহত্যা দিবসে আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য দেন মো. জুলফিকার রহমান

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত মানব ইতিহাসের অন্যতম বর্বরতম গণহত্যা সম্পর্কে ব্রাজিলের জনগণকে সচেতন এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে জনমত গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদি প্রচারণার অংশ হিসেবে দেশটির রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে সেমিনার। বাংলাদেশ দূতাবাস এই সেমিনারের আয়োজন করে। ২৫ মার্চ রোববার ব্রাসিলয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিল—Bangladesh: A Journey from the Devastation of 1971 Genocide to a Developing Country in 2018.

গণহত্যা দিবসে আয়োজিত সেমিনারে আলোচনা
গণহত্যা দিবসে আয়োজিত সেমিনারে আলোচনা

বিভাগের হলরুম ভর্তি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো আয়োজিত এ সেমিনারে দু'টি বিষয় প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রথমত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত এ নির্মম গণহত্যা সম্পর্কে ব্রাজিলের এমনকি শিক্ষিত জনগণেরও তেমন কোনো ধারণা নেই। সেমিনারের পুরো দুই ঘণ্টারও বেশি সময় এ কারণে উপস্থিত সবার চোখেমুখেই ছিল এক ধরনের বেদনার্ত বিস্ময়। দ্বিতীয়ত সেমিনারটি বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আয়োজিত হলেও গণহত্যা ছাড়াও বাংলাদেশের সমসাময়িক উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়েও অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা, ভারত, পাকিস্তান ইত্যাদি বিষয়েও নানা প্রশ্ন উঠে আসে প্রশ্নোত্তর পর্বে।

গণহত্যা দিবসে আয়োজিত সেমিনারে উপস্থিতির একাংশ
গণহত্যা দিবসে আয়োজিত সেমিনারে উপস্থিতির একাংশ

সেমিনারের মূল আলোচক ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান তাঁর আলোচনায় বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম। ধর্ম ছাড়া আর কোনো বিষয়েই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোনো সাযুজ্য ছিল না। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাঙালিরা স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বাহক ছিল। পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলিম নেতারা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করলেও নতুন পাকিস্তানে তাঁরা পরিত্যক্ত হন এবং পাঞ্জাবিরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পেলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ ও সৈন্য সমাবেশের পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে গণহত্যা শুরু করে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ ও দুই লাখ নারী ধর্ষিত হন।

স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মো. জুলফিকার রহমান
স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মো. জুলফিকার রহমান

বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে আয়োজিত এ সেমিনারে বিপুল উপস্থিতি ও প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে তা প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে এটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে নিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদ্‌যাপন

ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসের আয়োজনে মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়েছে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এ উপলক্ষে ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি হোটেলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাঁকজমকপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আরি ডি কিনটেলা।

স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আরি কিনটেলা
স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আরি কিনটেলা

এতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া ছাড়াও ব্রাসিলিয়ার কূটনৈতিক কোরের অধিকাংশ রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক এ সংবর্ধনায় যোগ দেন। এ ছাড়া ব্রাজিলের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সুধীসমাজ, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিনিধিসহ প্রায় তিন শ অতিথি উপস্থিত ছিলেন।

স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ
স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ

অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান আংশিক ব্রাজিলিয়ান-পর্তুগিজ ভাষায় বক্তব্য দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তিনি বলেন, সুদীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালির শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বাভাবিক আর অবধারিত পরিণতি হিসেবেই ১৯৭১ সংঘটিত হয় বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধ। বিশেষত ২৫ মার্চের রাতে শুরু হওয়া ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের পর বাঙালির রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। সে কারণেই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ
স্বাধীনতা দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ

জুলফিকার রহমান বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান হারানো দুই লাখ মা-বোনের প্রতি গভীর সম্মান জানিয়ে বলেন, ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বর্তমানে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তিনি বাংলাদেশের রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজে বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের সহযোগিতা কামনা করেন।
ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আরি কিনটেলা তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতিতে বাংলাদেশের জনগণকে ব্রাজিলের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, দুই দেশের জনগণের স্বার্থে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ-ব্রাজিলের সম্পর্ক উচ্চতর পর্যায়ে নেওয়ার কাজ জোরদার করা হবে। বিজ্ঞপ্তি