আমাদের মা

মায়ের সঙ্গে লেখিকা (ডানে) ও তাঁর বোন রিপা
মায়ের সঙ্গে লেখিকা (ডানে) ও তাঁর বোন রিপা

ছোটবেলায় হ‌ুমায়ূন আজাদের ‘আমাদের মা’ পড়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের মাতো হ‌ুমায়ূন আজাদের আমাদের মায়ের মতো নন। তবে কি আমাদের মা ভালো মা নন?

আমরা তো আমাদের মাকে ছাড়িয়ে আকাশ দেখতে পারতাম না। মনে হতো মা নিজেই তার আত্মীয় কেউ। আমাদের মা বাবার পাশে দাঁড়াতেন দ্বিতীয় সম্রাটের মতো। মাকে মনে হতো আলেক্সান্দ্রোস হোমেগাস। আমাদের বাবার ছিল সম্রাটের মতো নাম—শাহজাহান! তাতে কী, আমরা দেখতাম আমাদের বাবার সাম্রাজ্যেও টাকার টান পড়ত। বাবা আস্তে করে বলতেন, কুসুম! তোমার কাছে কিছু হবে? আমাদের মা সম্রাটের মতো বলতেন, লাগবে কত?
আমাদের মার মাড় দেওয়া শাড়ি বালিশের নিচে ইস্ত্রি হতো রোজ!
আমাদের মাকে দুধভাত চুক চুক ঘন হয়ে থাকা পাতে দুধ ছাড়িয়ে নেবার পরে আমরা পাইনি কখনো। আমাদের মা তখন দেয়াল ঘড়িতে নয়টা-পাঁচটা। দূরে কোথাও মার অফিসের ব্যাগে চুপ চুপ করে ঘামছে আমাদের জন্য কিনে রাখা দুধ।
আমাদের মা, যখন-তখন তার কোলে চড়ুই পাখির ডিম, আমরা পাড়তে পারতাম না। অফিশিয়াল টাইমে আমাদের মায়ের বন্ধ দুটি ডানা। আমরা মন খারাপ করতাম। ওই যে পাশের বাড়ির কেতনের মাতো এমন না!
আমাদের মা অবসরে যখন ডাকতেন আমরা হুড়মুড়িয়ে তার ডানার ভেতরে ডুকে পড়তাম। বলতে চাইতাম জানো মা, ওই বাড়ির কেতন সব সময় তার মায়ের আঁচলের খুঁটি ধরে কাঁদতে পারে।
আমাদের মার দিনরাত টলমল করা অশ্রু বিন্দু ছিল না।
আমাদের মা সারা দিন ধরে খুলে রাখা আমাদের বুক পকেটের আদর বোতামটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলতেন, সব মা–ই ভিন্ন। আবার সব মা–ই এক। মায়েদের সঙ্গে মায়েদের তুলনা কখনোই করতে হয় না, মা।
আমাদের মাও বুনো ফুলের পাপড়ি ছিলেন, কিন্তু তাঁকে ঝরে ঝরে পড়তে দেখিনি কখনো। আমাদের মায়ের কাজল চোখ বাবা ঘরে ফিরলেই তুলত খোঁপা। আমাদের মাও ছিলেন ধানের খেত। সোনাঝরা ফসল কৃষক ঘরে তুলে দিত। বাবাকে না পেলে মা-ই সব চুকিয়ে দিতেন।। আমাদের মা, আমাদের মায়ের বাইরেও কেউ একজন ছিল।

জাহান রিমা: প্যারাডাইজ ডেন্টাল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।