নিশ্চিত বিমান দুর্ঘটনা থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা

এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটের পাইলটের সঙ্গে লেখক
এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটের পাইলটের সঙ্গে লেখক

সিডনিতে রাতেই খবর পেয়েছিলাম নেপালে ইউএস বাংলা বিমান দুর্ঘটনার। তার পরদিন সকাল থেকেই বিমান দুর্ঘটনার সব খবর পড়ার চেষ্টা করলাম। পড়তে পড়তে মনটা আবারও বিশেষ রকমের খারাপ হয়ে গেল। এই দুর্ঘটনা আবারও আমাকে ফিরিয়ে নিয়েছিল এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারির এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটে। আমরাও হতে পারতাম এমন একটি সংবাদের শিরোনাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে ফিরেছিলাম সেদিন। এই ঘটনার এক মাসেও ঘটনাটা লিখতে গিয়েও লিখতে পারিনি, এই খারাপ লাগার জন্যই।

দিনটা অন্যান্য দিনের চেয়ে বরং একটু বেশিই সুন্দর ছিল। মেঘমুক্ত হালকা শীতের সকাল, সোনালি রোদ। আমি আমার একমাত্র মেয়েসহ এক মাসের ছুটি শেষে ফিরে যাচ্ছিলাম প্রবাসের কর্মব্যস্ত নিষ্প্রাণ জীবনে। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই এগোচ্ছিল। পরিবারের প্রিয় মানুষগুলোই এসেছিল বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল ঢাকা বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপি শরীফ। দুই বন্ধু মিলে ছবিও তুলেছিলাম এবং তা যথারীতি পোস্টও দিয়েছিলাম বিমান ওঠার আগে শেষ পোস্ট হিসেবে। আমার বন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম ভিআইপি পাসিংয়ের জন্য আমাদের প্লেন ছাড়তে এক ঘণ্টা দেরি হবে, হয়েছিলও তাই।
২০০৬ থেকে বিদেশে যাতায়াত করা আমি প্রায় প্রতি বছরই একবার বা একের অধিকবার দেশে এসেছি। প্রতিবারই যখন ঢাকা ছেড়ে যাই, প্লেনের জানালা দিয়ে প্রিয় শহরটাকে যতক্ষণ দেখা যায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দিনটা এত পরিষ্কার ছিল যে জানালা দিয়ে আমার মেয়েকে সিএমএইচ হাসপাতালের বিল্ডিংটা পর্যন্ত দেখিয়েছিলাম। কারণ তার ঠিক পেছনেই ছিল আমাদের বাসা। সুন্দর উড্ডয়নের পর প্লেন সুন্দরভাবেই এগোচ্ছিল, যথারীতি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর বিমানবালারা গরম রুমাল দিয়েছিল। একটু পর তাঁরা আমাদের ড্রিঙ্কসও দিয়ে গিয়েছিল।
সিঙ্গাপুর যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি লাগে না, যার প্রায় ৫০ মিনিট চলে গিয়েছিল। প্লেনটা তখন সাগরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। আমি এয়ারলাইনসের বইয়ে ঘুম ঘুম চোখে চোখ বোলাচ্ছিলাম কোনো মুভি দেখা যায় কিনা। ১৯০ জন যাত্রী নিয়ে ৩৩ হাজার ফুট ওপরে থাকা বিমানটি হঠাৎ বিকট শব্দে বিশাল ঝাঁকুনি মেরে আমাকেসহ সব যাত্রীদের জাগিয়ে তুলে সকল মনোযোগ কেড়ে নিল। এত দিনের প্লেন জার্নির অভিজ্ঞতায় আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা স্বাভাবিক কোনো শব্দ বা ঘটনা নয়। আমাদের আসন ছিল সামনের দিকে, বিশাল বড় প্লেনটার পেছনের বাম দিক থেকে কিছু শোরগোল ভেসে আসছিল। তখনো টের পাইনি কী সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
পরে শুনেছিলাম পেছনের বাম দিকে যারা বসেছিলেন তাঁরা জানালা দিয়ে বাম দিকের ইঞ্জিনে আগুন জ্বলতে দেখেছিলেন বলেই শোরগোলটা উঠেছিল। কিছুক্ষণ পর সে শোরগোলটা থেমেও গেল কিন্তু প্লেনটি এত ওপরেই অস্বাভাবিক শব্দের সঙ্গে কাঁপতে শুরু করল। ক্রমেই এই অস্বাভাবিক শব্দ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনিটা ঝাঁকুনিতে পরিণত হতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম দিকে কেউ কেউ কিছু বলার চেষ্টা করলেও ঘটনার ভয়াবহতা টের পেয়ে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। এর মধ্যেই পাইলটের প্রথম কথোপকথন এয়ারে ভেসে এল। পাইলট স্পট করেই বললেন যে, বাম পাশের ইঞ্জিনটায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় আমরা বন্ধ করে দিয়েছি, আমরা এখন ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিংয়ের জন্য ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সেই সঙ্গে তিনি সবার সহযোগিতা চাইলেন।
আমার কাছে মনে হচ্ছিল এত ঝাঁকাতে থাকা প্লেন তিনি কোনো অবস্থাতেই ঢাকা পর্যন্ত নিতে পারবেন না, পথেই ক্র্যাশ করবে। আমাদের শুধু শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছেন। (এখানে বলে রাখা ভালো যে পরবর্তীতে আমি পাইলটের থেকে জেনেছিলাম ওই সময় আসলে কী ঘটেছিল। তিনি বলেছিলেন যে ৩৩ হাজার ফুট ওপরে থাকা অবস্থায় আমাদের প্লেনের বামের ইঞ্জিনে হঠাৎ আগুন ধরে গিয়েছিল। এত ওপরে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৪৫ ডিগ্রির নিচে এবং কোনো অক্সিজেন না থাকায় আগুন ছড়াতে পারেনি। সিস্টেম অটোমেটিক ইঞ্জিনটাকে বন্ধ করে দিয়েছিল। ডানের এক ইঞ্জিনে প্লেনটা চলছিল। কিন্তু আগুনে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা ছিল না। হতে পারে ল্যান্ডিং গিয়ার, প্রপেলারের ব্লেড বা ইলেকট্রিক ওয়্যার বা অন্য কিছু নষ্ট হয়ে থাকতে পারে। তিনি সেটা ধরে নিয়েই সম্পূর্ণ ধীরস্থির থেকে বিমান চালিয়েছিলেন)।

এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটের কো-পাইলটের সঙ্গে লেখকের মেয়ে
এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটের কো-পাইলটের সঙ্গে লেখকের মেয়ে

আমি নিজেকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণে আছে। ইতিমধ্যেই ঘড় ঘড় শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্লেনের ভেতরের ঝাঁকুনিটা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। আমার সামনের মনিটরে আমি প্লেনের অবস্থান দেখার চেষ্টা করলাম। প্লেনটা তখনো ৩০ হাজার ফুট ওপরে এবং মিয়ানমারের কাছাকাছি সাগরে অবস্থান করছে। এর কিছুক্ষণ পর পাইলট মাইক্রোফোনে আবারও বললেন, আমাদের অবস্থানের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর মিয়ানমারের মিন্দালাও বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের জন্য যোগাযোগ করেছি, আমরা ঢাকাতে না গিয়ে মিন্দালাওয়ের দিকে যাচ্ছি এবং তিনি যথারীতি সবার সহযোগিতা চাইলেন।
তখন ভেতরের পরিস্থিতিটা বলে বোঝানোর মতো নয়। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। ঝাঁকুনিটা ক্রমাগত বাড়ছিল এবং সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক ঘড় ঘড় শব্দ। ঝাঁকুনিগুলো এমন তীব্র ছিল যে প্লেনের ভেতরে হাঁটার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না। একপর্যায়ে ঝাঁকুনিতে আমাদের সামনের টয়লেটের দরজাটা খুলে গিয়ে বারি খেতে লাগল, বিমানবালাসহ কারও সাহস হলো না উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে। বিমানে বেশির ভাগ যাত্রী বাংলাদেশি ছিলেন বিধায় চতুর্দিক থেকে দোয়া দরুদ আর কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। আমার পাশের অন্য সিটে বসা নারী তাঁর দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছেন, আমাদের বরাবর সামনে বসা বিমানবালা এক মিনিটের জন্যও কান্না থামাননি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি এমন দোলায়মান ভয়ংকর রাইডে বসে আছি যা আমাকে মৃত্যু উপত্যকায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে আমি চাইলেও আমার আর মুক্তি নেই। আমি আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, পাছে আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে সে আরও ভড়কে যায়। আমার মেয়ে এমনিতেই অনেক চাপা স্বভাবের, কোনো কিছুই সে সহজে প্রকাশ করে না। আমি বললাম, মা দোয়া যা জান সেগুলো পড়। সে বলল হ্যাঁ, আব্বু আমি পড়ছি। মরণের ভয় আমাকে পেয়ে বসল।
জীবনে অতটা ধার্মিক আমি কখনই ছিলাম না। তারপরেও আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলাম, আমি জীবনে জ্ঞানত কোনো পাপ করিনি, নামাজ রোজার গাফিলতি ছাড়া, তুমি আমার প্রস্থান আল্লাহ এভাবে করাতে পার না। আল্লাহ আমাকে বাঁচাও, আমার যে কোনোই প্রস্তুতি নাই। আমি যে কারও জন্যও এখনো কিছু করতে পারিনি। ছোট সময় বাবা হারানো সংসারে আমি অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। সব প্রিয়জনের মুখগুলো মনে হতে লাগল। স্কুল-কলেজজীবনে হোস্টেল থেকে ছুটিতে যখন বাড়িতে যেতাম, আমার ছোটরা রাতে কে আমার সঙ্গে ঘুমাবে এই নিয়ে মারামারি লেগে যেত। শেষে সবাই জড়াজড়ি করে একসঙ্গেই ঘুমাতাম আমাদের ছোট্ট ঘরটায়।
এই ভালোবাসার দায় আছে আমার ওপর। এগুলো মিটাতে পারিনি, মিটাতে পারিনি বউ বাচ্চাদের দায়। আমার তেমন কোনো সহায় সম্পত্তি নাই, তারপরও যা আছে তা নিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে কখনো খোলামেলা আলাপ করা হয়নি। যদিও আমার স্ত্রীর সহায় সম্পত্তি নিয়ে অনাগ্রহ থাকার কারণে তাঁর নামেই যে কোথায় কী রেখেছি সেটাও তাঁকে ঠিকমতো জানানো হয়নি। নিজের এই বোকামির কথা মনে করে আরও খারাপ লাগতে লাগল। আমি মারা গেলে আমার অস্ট্রেলিয়ার সবকিছু সে কীভাবে সামাল দেবে। তাঁর একাকী যুদ্ধটার কথা মনে করে খুব খারাপ লাগছিল।

মিন্দালাও বিমানবন্দরে এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটের যাত্রীরা
মিন্দালাও বিমানবন্দরে এসকিউ ৪৪৯ ফ্লাইটের যাত্রীরা

আমার মনে হচ্ছিল আমার প্রস্থান দুই দুটি পরিবারকে একবারে অসহায় করে ফেলবে। আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ শাইয়ান এবং আমার স্বপ্নের শাইয়ান ফাউন্ডেশনের কথা মনে করে কান্না সংবরণ করতে পারছিলাম না। খোদাকে বলছিলাম, তুমি এদের জন্য হলেও আমাকে বাঁচাও এবং এই প্লেনটাকে রক্ষা কর। পরক্ষণেই মনে হলো, প্রকৃতি কখনোই বৈষম্য করে না-সাদা বা কালো, ভালো বা মন্দ, ধনী বা দরিদ্র, যুবক বা বয়স্ক, হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিষ্টান হিসেবে। অতএব প্লেন ক্র্যাশ করলে আমি যেই হই অন্য সবার মতো আমারও পরিণতি অবধারিত। কাজেই আমার সেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
তাই আমি তখন আমি মারা গেলে পাসপোর্ট দেখে লাশটা যেন চিহ্নিত করতে পারে সেই জন্য আমার ও আমার মেয়ের পকেটে পাসপোর্টটা ঢুকিয়ে নিলাম। ইমারজেন্সি কিটগুলো কীভাবে কাজ করে সেটাও আবার মেয়েকে দেখিয়ে দিলাম, যদিও ক্র্যাশ করলে এগুলো কোনো কাজেই দেবে না। দোয়া দরুদ ও তওবা পড়তে লাগলাম। এর মধ্যেই পাইলট বলল আমরা আর পাঁচ মিনিট পরেই ল্যান্ড করতে যাচ্ছি, কিন্তু এটা ছিল তাঁর একটি টেকনিক আমাদের শান্ত রাখার জন্য। আসলে তারও প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর প্লেন ল্যান্ডিংয়ের জন্য তৈরি হয়। আমি অস্ট্রেলিয়াতে Air Crash Investigation নামে একটি টিভি প্রোগ্রাম এক সময় প্রায় নিয়মিত দেখতাম। সেই অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতায় আমি জানতাম প্লেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওঠার সময় ও ল্যান্ডিংয়ের সময় ক্র্যাশ করে থাকে। আর আমাদের প্লেনের যে অবস্থা তাতে আমার বিশ্বাসই হতে চাইল না যে এটা কোনোভাবে ল্যান্ড করানো সম্ভব!
মিন্দালাও বিমানবন্দরে অনেক আগে থেকেই প্লেনটা অনেক নিচে দিয়ে চলছিল। আমরা নিচের পাহাড়, পাহাড়ের চূড়ার প্যাগোডা দেখতে পাচ্ছিলাম। এর কারণ পাইলট পরবর্তীতে আমাকে বলেছিলেন, যদি ক্র্যাশ করে তাহলে যেন ক্ষতি কম হয় এবং এক ইঞ্জিনে চলার সময় ডানের ইঞ্জিনটাও সমস্যা করছিল। যে ব্যাপারটা আমরা যাত্রীরাও টের পেয়েছি তখনই কারণ ডানের ইঞ্জিনটা যখন বন্ধ হতো, তখন প্লেনে কোনো শব্দ থাকত না, বন্ধ হয়ে যেত ঝাঁকুনিটাও। এই রকম হয়েছে দুবার, আবার চালু হয়েছে। প্লেনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি অবশ্য আমাদের চেয়ে পাইলটই বেশি টের পেয়েছেন, তারপরও উনি নার্ভ শক্ত করে যে কীভাবে চালিয়ে গেছেন তা আল্লাহই ভালো জানেন।
আমরা ল্যান্ডিংয়ের জন্য প্রস্তুত হলাম। আমি মেয়েকে বললাম, মা আমি যা যা করব, তুমিও খুব দ্রুত তাই তাই করবে। সেই সময় সবাই কে কী করেছে, কে কারটা খেয়াল করে। সবাই জীবনের শেষ মুহূর্ত, নয়তো জীবনটা নতুনভাবে ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্লেনটা মনে হলো একটু ডানে কাত হয়েই ল্যান্ড করল এবং খুব শক্ত ব্রেক চেপে খুব স্বল্প দূরত্বে থামিয়ে দিল।
আহা সেই মুহূর্ত, জীবনকে হারাতে গিয়েও ফিরে পাওয়া, সবার সে কী অনুভূতি, যা জীবনেও ভুলব না। সবার সে কী কান্না, চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। সেই কান্নার মাঝেই কেউ কেউ তালিও দিল পাইলটের দক্ষতা দেখে। জানালা দিয়ে দেখলাম রানওয়ের চারদিকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। সবাই দৌড়াদৌড়ি করছেন কিন্তু কেউ কাছে আসছেন না। কেউ ভিডিও করছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কিন্তু কাছে আসছেন না।
এর মধ্যে আমাদের পাইলটের আবার সেই অভয় দেওয়া কণ্ঠ বলছিল—আমাদের প্লেন থেকে ফুয়েল লিক হচ্ছিল যেটা আমরা জানতাম না। গ্রাউন্ড স্টাফদের পরামর্শে আমরা সব ধরনের মেশিন বন্ধ করে দিচ্ছি, সাময়িক অসুবিধার জন্য জন্য দুঃখিত। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে। তারপর অনেক সময় এসি ছিল না, অনেকক্ষণ প্লেনেই বসে থেকেছি, নিচে পানি মারতে দেখেছি। পরে অন্য জায়গায় প্লেনটা টেনে নিয়ে আমাদের নামিয়েছিল। এ সময় কারও কোনো ধৈর্যচ্যুতি দেখিনি, বেঁচে যাওয়ার আনন্দেই সবাই দিশেহারা। আমরা মুসলিম যারা ছিলাম, তাঁরা প্রায় সবাই নেমেই নফল নামাজ পড়েছিলাম।
এরপর লম্বা সময় (প্রায় দশ ঘণ্টা) আমাদের মিন্দালাও বিমানবন্দরে বসিয়ে রেখেছিল, তারপরও কেউ কোনো কিছু বলেনি। সবাই শুধু বলেছে, জীবনটা ফিরে পেয়েছি, এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার আছে। সবার মাঝে এই আলোচনাই শুধু ছিল এটা কী হয়ে গেল! সবাই পরে পাইলটকে কাছে পেয়ে সে কী আবেগ, ইংরেজি না জানা চাচারাও এসে বাংলায় তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কথা বলেছেন, যা আমি পাইলটকে ভাষান্তর করে দিয়েছি। পাইলট বলেছিল তার চব্বিশ বছরের পাইলট জীবনে এই রকম ঘটনা এইবারই প্রথম ঘটেছে। তার সাহসিকতার জন্য আমিও তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি। এসকিউ ৪৪৯-এ আগুন লাগার পর থেকে ল্যান্ডিং পর্যন্ত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট সময়ই আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণাময় স্মরণীয় সময়। এ ছাড়া এর পরের দুই দিনের সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের অব্যবস্থাপনা ছিল উল্লেখ করার মতো।
এই ঘটনায় অনেক শিক্ষা হয়েছে আমার ব্যক্তিজীবনে। এই ঘটনার পর অনেকের ফোন ধরিনি কারণ মানসিক অবস্থাটা কয়েক দিন ভালো ছিল না। পরিবারের লোকজনের বাইরে খুব কম মানুষের সঙ্গে ঘটনাটা শেয়ার করেছি। মনে পড়ে, বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক ঘাত প্রতিঘাতে বড় হয়েছি, কাজেই কান্নাটা আমার সয়ে গিয়েছিল কিন্তু ঘটনার পরদিন অনেক বছর পর অঝোরে কেঁদেছিলাম যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। মা-ছেলে প্রায় ৭-৮ মিনিট কোনো কথাই বলতে পারিনি। আল্লাহর কাছে অনেক শোকরিয়া যে উনি পাইলটের দক্ষতার অছিলায় বা মানুষের দোয়ার অছিলায় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এই জন্য। আমার মনে পড়ে, দূরের বা কাছের অনেক মানুষ আমাকে গায়ে হাত দিয়ে মন খুলে দোয়া করতে দেখেছি, আমার দুই মাও আমাকে সব সময় গায়ে হাত দিয়ে দোয়া করেন। তাঁদের দোয়ার বরকতে আমি আজও বেঁচে আছি। আমার দুর্ঘটনার কথা শুনে যারা আমাদের এলাকার বিভিন্ন মসজিদে জুম্মার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করেছিলেন এবং অংশগ্রহণ করছিলেন, তাঁদের সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো শত্রু নেই, কারও সঙ্গে অভিমান থাকতে পারে কিন্তু কারও সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব নেই। এই নতুন করে বেঁচে থাকায়-আমার উপস্থিতি কোথাও দ্বন্দ্বের জন্য হবে না, ভাঙনের জন্য হবে না, হবে শুধুই গড়ার জন্য, বন্ধনের জন্য। আমি আমার স্বপ্নের শাইয়ান ফাউন্ডেশনকে নিয়ে নতুন করে এগিয়ে যেতে চাই। আহা জীবন, আসলেই জীবনটা অনেক সুন্দর।

ড. আসাদুজ্জামান সেলিম : সিডনি, এনএসইউ, অস্ট্রেলিয়া