অনুতাপের রক্তক্ষরণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর বুকের মধ্যে গড়ে ওঠা কড়াইল বস্তি থেকে ঠিক তিন কিলোমিটার দূরে সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা বাড়িটির নাম সুনিবাস। পরিপাটি করে পেঁচিয়ে ওঠা সবুজ লতা পাতায় ল্যাপটানো সীমানা প্রাচীর আর বাড়ির নাম দেখে বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই এটা একটা বৃদ্ধাশ্রম।

সন্তানের কাছে বাবার বেশি কিছু চাওয়ার নেই। শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করবার ইচ্ছা; এতটুকুন যা চাওয়ার। কিন্তু বয়সের শেষ ভাগে মস্ত বড় ফ্ল্যাটের ঘরের কোণেও বাবার জন্য সামান্য জায়গা মেলে না। যে টুকুন মিলেছে তার সন্তানের কাজের ছেলেটার। এই কঠিন সত্যকে মেনেই এক সময়ের ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তা কামাল সাহেব গত তিন বছর যাবৎ এই আশ্রমের একজন বাসিন্দা।
৩৫ বছর বয়সে বিপত্নীক এই মানুষটা জীবনের পুরোটা সময় অর্জিত ধন-সম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন একমাত্র সন্তান জনিকে মানুষ করার জন্য। নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। করপোরেট জগতে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা তার সন্তান জনি কামালের টাকা পয়সার অভাব ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর থেকে কেন জানি বদলে যাচ্ছিল। বাবাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ না করার ব্যাপারটা বিভিন্ন পন্থায় তার আচরণে প্রকাশ পাচ্ছিল। ছেলে আর ছেলের বউ অবহেলা আর দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যেন তাঁর সাধের সন্তানের ঘর থেকে তিনি নিজে থেকে সরে যান।
কী আর করা! ওপারে চলে যাওয়া প্রিয়তমা বউয়ের একটা সাদাকালো ছবি বুক পকেটে নিয়ে, শিরা উপশিরা ও প্রতিটি কোষ জুড়ে কষ্টের শোক চিহ্ন আঁকা এক সন্ধ্যায় সুনিবাসে গিয়েই নিজে থেকে তার ছেলেকে দায়মুক্তি দেন।
প্রথম দিকে খুব কষ্ট হতো। যে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার জন্য নিঃস্বার্থভাবে পরিশ্রম করে গেছেন সেই সন্তানই কিনা তাকে বোঝা ভেবে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করেছে। এ রকমটা হবে কখনোই ভাবতে পারেননি। টানা নির্ঘুম রাতগুলোতে সাইরেন বাজিয়ে ধেয়ে আসত স্মৃতির যন্ত্রণা আর কষ্টের অজস্র অনুভূতিরা। তবুও প্রতিবাদ দানা বাঁধে না। মন অভিশাপ দেয় না। সে যে নাড়ি ছেঁড়া ধন। তাই চুপ করেই থাকেন। একেবারে চুপ।
দিন গড়িয়ে প্রতিদিন রাত আসে। সপ্তাহের সিঁড়ি ভেঙে মাস হয়। সবকিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে কামাল সাহেবের কাছে।

দুই.

সন্তানের কাছে পায়নি তাতে কি? সারা জীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা পেয়েছেন এই আশ্রম থেকে। এখানেই তিনি নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারবেন।
বৃদ্ধাশ্রমে অপেক্ষাকৃত বেশি শিক্ষিত, হাস্যোজ্জ্বল ও মিশুক হওয়াই নিবাসের সবার নেতৃস্থানীয় মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন দিনদিন। অন্যান্য সকল আশ্রম নিবাসীসহ সব কর্মচারীর কাছে আলাদা একটা সম্মানের পাত্র হয়ে উঠেছেন। নিবাসী কিংবা কর্মচারী যে কেউ যেকোনো সময় তাদের যাপিত জীবনের সুখদুঃখ তাঁর সঙ্গে শেয়ার করে। শলা পরামর্শ করে। তাঁর সাজেশন চায়।
কামাল সাহেব গত কদিন ধরে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছেন, গফুর নামের একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব কর্মচারী কিছুদিন যাবৎ কেন জানি মনমরা হয়ে আছে। সাধারণত তাঁকে এ রকম গম্ভীর মনে হয় না। এ রকম মন খারাপ করে থাকার লোকও না। সবার সঙ্গে হাস্যরস করা আড্ডাবাজ মানুষ। কোনো সমস্যা হলে সে কামাল সাহেবের কাছে সমাধান চায়। কিন্তু ইদানীং কেন জানি মন খারাপ করে দূরে দূরে থাকছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা হয়েছে তাঁর।
একদিন বিকেলে কামাল সাহেব গফুরকে ডেকে বললেন, বেশ কদিন ধরে আমি খেয়াল করছি, তুমি মন খারাপ করে আছ। আমি তোমার বাবার মতোই। আমাকে খুলে বলো বাবা। তাতে তোমার মন হালকা হবে।
গফুর কিছু হয়নি চাচা বলে প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে খুলে বলেছে।
—চাচা বেশ কিছুদিন ধরে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। গ্রামে দেখানোর জন্য তেমন ভালো ডাক্তার নেই বললে চলে। এদিকে আপনার বউমার ভয়ে ঢাকাই এনে সুচিকিৎসা করাব সেটাও করতে পারছি না। বাবাকে ঢাকা এনে চিকিৎসা করানোর কথা পাড়লেই সে গজগজ করতে থাকে। বাবাকে আনলেই আমি নিশ্চিত, সে ঝগড়া বাধিয়ে ছাড়বে। কি করব বুঝতে পারছি না চাচা।
কামাল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর গফুরের মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, দেখ গফুর, আমি আমি আমার কথা বলি। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পর থেকে থেকে আমরা হানিমুনে যাইনি। টাকার অভাবে কিংবা ব্যস্ততা কারণে নয়। মূল কারণটি ছিল আমাদের একমাত্র সন্তান জনি। তাকে মানুষ করতে গিয়ে যাতে কোনো ধরনের কমতি না থাকে সে চিন্তা করে আর যাওয়া হলো না। তবে আমাদের খুব ইচ্ছা ছিল, আমাদের হানিমুনের ব্যবস্থাটা বড় হয়ে আমার ছেলেই করবে। কিন্তু সেটা আর হলো কই? পঁয়ত্রিশে তোমার চাচিকে হারালাম। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করা হলো না। অবশ্যই পরে বুঝতে পেরেছি সে আমাকে রেখে ওপারে পালিয়ে বেঁচে গেছে। নইলে তার অবস্থাও আমার মতোই হতো। নিজের ঘর হারিয়ে জায়গা হতো রাস্তায় না হয় বৃদ্ধাশ্রমে।
বাবা–মার সন্তান জন্ম দেওয়ার পর একটাই চিন্তা থাকে সন্তানকে মানুষ করতে হবে। তারপর বাবারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, পড়ায়, ভরণ পোষণ করে। বড় করে তোলে। নিজের হাতে গড়ে দিই একজন সন্তানের ভবিষ্যৎ। আর সন্তান কিনা বড় হয়ে এ রকম মানুষগুলোর এতদিনের ভালোবাসা না দেখে পড়ে থাকে হঠাৎ করে জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসা বউয়ের ভালোবাসায়। আমি বলছি না বউকে ভালো না বাসতে, কিন্তু আমি বলব বউকে ভালোবাসতে গিয়ে কোনো ভাবে যাতে মা–বাবার প্রতি ভালোবাসায় কমতি না হয়। আমি বলছি না বউয়ের কথা শোনা যাবে না। কিন্তু আমি বলব, বউ যখন অন্যায় কথা বলবে সেটা কোনো মতে রাখা যাবে না। এবার তুমি যেটা ভালো মনে করো।
গফুর কামাল সাহেবের কথা শুনে কাঁদছে। এই মুহূর্তে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না, কষ্টটা আসলে কার জন্য হচ্ছে। তাঁর বাবার জন্য নাকি তার সামনে বসা কামাল সাহেবের জন্য। গফুর কাঁদতে কাঁদতে কামাল সাহেবকে কথা দেয়, আগামীকালই সে তার বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে।

তিন.

কড়াইল বস্তির সীমানা ঘেঁষা ডুপ্লেক্স দ্বিতল বাড়ির ওপর তলার ব্যালকনিতে কফির মগ হাতে জনি কামাল প্রতিদিন সকালের পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নেন। অফিসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সে এই জায়গাটাই বসে পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি স্বচ্ছ সকালের এক টুকরো আকাশ দেখে নেন। ঢাকা শহরের কোনো কোনো জায়গায় বহুতল ভবনের ফাঁকফোকর গলে সামান্য আকাশ উঁকি দিলেও এই বস্তির ঝুপড়ি ঘরগুলোর ওপরের আকাশটা বেশ বড়সড়। তাই এই জায়গাটা তার খুব প্রিয়।
গত কদিন ধরে ব্যালকনি থেকে একটা দৃশ্য তার নজর কেড়েছে। নজর কেড়েছে বললে ভুল হবে, তার মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। ঠিক সকাল আটটা বাজলে ব্যালকনি থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরত্বের এক ঝুপড়ি ঘরের সামনে প্রতিদিন নিয়ম করে একজন পঁয়ত্রিশোর্ধ ছেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে ধরে ধরে একটা হাতল চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারপর রোদের আঁচে আঁচে বৃদ্ধের শরীরে তেল মেখে দেয়। যত্ন করে চুল আঁচড়ে দেয়। নখ কেটে দেয়। ছেলেটা নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। সবশেষে নিজ হাতে ওষুধ খাওয়ানোর পর বাবাকে সালাম দিয়ে কাজে বের হচ্ছে। বৃদ্ধটাও হাসি মুখে তার ছেলেকে বিদায় দেন।
—গফুর সাবধানে চলাফেরা কইরো। গাড়িঘোড়া দেইখা যাইয়ো বাপজান।
গত কয়েক দিন ধরে একই দৃশ্য জনির মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। একদিন, দুই দিন, তিন দিন এইভাবে উনিশটা দিন একই দৃশ্যটা মনের মধ্যে টুপ করে কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে।
কাটখোট্টা শক্ত চেহারার বাবার আক্ষেপ ও হতাশায় পরিপূর্ণ সেই করুণ পরাজিত চেহারাটা দংশন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে চেহারাই লেখা ছিল ভালোবাসার খুনসুটি আর হাস্যোজ্জ্বলে ভরা এক টুকরো আকাশ চাওয়ার আকুতি।
বস্তির ঝুপড়িতে বসবাস করা অশিক্ষিত একটা লোক তার বৃদ্ধ বাবাকে এত যত্নআত্তি করছে অথচ সে কিনা ডুপ্লেক্স বাড়িতে বসবাস করে তার করপোরেট জীবনের কারিগর বাবাটাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করেছে! ব্যাপারটা সুনামির তাণ্ডব হয়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে।
আরে! একদিন তো আমারও সময় আসবে। আমার সন্তানেরা এ রকম আচরণটা আমার সঙ্গে করবে নাতো? আমাকেও এ রকম বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে নাতো? ভাবতেই কেমন জানি নিশপিশ করে উঠছে জনি কামালের ভেতরটা। যতই দিন যাচ্ছে তত বেশি তোলপাড় করে দিয়ে যাচ্ছে সবটা। ভেতর আত্মার কোথায় যেন বোবা কান্না খামচে ধরেছে। যা মাঝেমধ্যে চাপা কান্না হয়ে দুমড়েমুচড়ে উঠে বের হয়ে আসছে। বদ্ধ কপাটের ওপার থেকে কে জানি বারবার বলে উঠছে, না এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। একটা বিহিত করতেই হবে।

চার.

অনেক দিন পর আজকের আলোকোজ্জ্বল সকালটা জনির কাছে অন্যরকম ফ্রেশ লাগছে। নিজেকে বেশ হালকা লাগছে এই মুহূর্তে। ফুরফুরে সকালের স্নিগ্ধ অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার মন জুড়ে। ব্যালকনির বাতাসে বিষাক্ত সিসার পরিমাণ অনেকটাই কম মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে অনুতপ্ত নামক অনুভূতির জোরালো ভাব।
দমকা বাতাসে ঝাপটার সঙ্গে একপশলা বৃষ্টি ছুঁয়ে দিল ভাবনার জগৎ। এলোমেলো করে ভিজিয়ে দিয়ে গেল হৃদয়ের আষ্টেপৃষ্ঠে। ধুয়ে মুছে একাকার করে দিল এক নতুন অধ্যায়ের যে অধ্যায়ে নতুন করে জন্ম নিয়েছে বাবার জন্য মাথা নুইয়ে পড়া ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আজকে তার পুরো পরিবার মিলে তার বাবা কামাল সাহেবকে সুনিবাস নামের বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফেরত আনতে যাচ্ছে। বুকের বামপাশে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জানান দিয়ে যাচ্ছে-লকলক করে বেড়ে ওঠা কলঙ্কিত ক্ষণ এবং অনুতাপের রক্তক্ষরণ শেষ হওয়ার আকণ্ঠ অপেক্ষার আজ পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।
আরেকটা সুন্দর নতুন সকালের সূচনায় বাড়ি থেকে বের হলো জনি কামাল ও তার পরিবার।

বশির আহমেদ রাকিব: জেদ্দা, সৌদি আরব।