এরাও তো পুরুষ

সাত সকালে একা বাসের যাত্রী লেখিকা
সাত সকালে একা বাসের যাত্রী লেখিকা

আপনি একা একটি মেয়ে কোনো বদ্ধ লিফটে উঠলেন আর সেই মাত্র একদল অপরিচিত যুবক সেখানে হাজির। আপনি নিশ্চিত মনে হয়তো নিজের মোবাইলে ব্যস্ত অথবা আপনমনে কোনো বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন। আপনাকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য বা যত সুন্দর হোন, শারীরিক কোনো হয়রানি করার চেষ্টা করবে না।

আপনি রাত দুটায় একা মেয়ে ট্যাক্সিতে করে বাড়ি ফিরবেন। ট্যাক্সিতে আরামে ঘুম দিতে পারেন। গন্তব্যে পৌঁছালে চালক আপনাকে ডেকে তুলবে। একা পথটুকু বাসায় ফিরতে একদল পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেও ভয়ে আপনার আত্মা কেঁপে উঠবে না।
চলন্ত বাসেও একা ভ্রমণে আপনি নিরাপদ বোধ করবেন। যদি সেটা দুই ঘণ্টারও দীর্ঘ হয়। চালক আপনার সমস্ত সুবিধা নিশ্চিত করবেন। সকালের কর্মব্যস্ত সময়ে ট্রেনে এত ভিড় থাকে যে, দাঁড়ানো কষ্ট হয়। তবু পুরুষগুলো এমনভাবে থাকে যেন কোনো নারীকে তার জন্য বিরক্ত হতে না হয়।
হাসপাতালে গেলেন। যদি এক্স-রে বা এমআরআই করতে হয়, কোনো বদ্ধ রুমে পুরুষ করাবে, তবু আপনাকে শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে কুঁকড়ে যেতে হবে না। কারণ এটা জাপান। গত পাঁচ বছরে জাপানের যে কয়টা জিনিস আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে সেটা হলো পুরুষদের কোনো নারীর প্রতি আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি। পৃথিবীতে যে কয়টা দেশ নারীদের নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে পথ চলা নিশ্চিত করতে পেরেছ, জাপান তার মধ্যে অন্যতম। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তরে নারীরা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করছেন। কেউ তাদের রাস্তাঘাটে হয়রানি করছে না, বাজে মন্তব্য করছে না!
এই আমি দেশে থাকতে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোথাও একা যাইনি। সেখানে এই ভিনদেশে রাতবিরাতে বাচ্চা নিয়ে পার্ক, শপিংমল, হাসপাতাল এমন কোনো জায়গা নেই যে একা যাইনি। সত্যি এতটুকু ভয় কাজ করেনি মনে। জানি কোনো সমস্যা হলে পুলিশ চলে আসবে নিমেষেই। বলতে দ্বিধা নেই, নিজ দেশে নিজ ধর্মের কিছু ভাইদের কাছে নিজেদের নিরাপদ ভাবিনি কখনো। এমনও হয়েছে রাতে দরজার খিল না লাগিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি। কষ্ট লাগে যখন শুনি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের দেশগুলোতে কিছুদিন পরপর নারীদের শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা কারও যেন রেহাই নেই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় জাপানিরা কোনো ধর্মীয় অনুশাসনে বিশ্বাসী নয় বা নারীদের পোশাকেও এদের সমস্যা করে না।
পথ চলতে গিয়ে বারবার একটা কথা ঘুরেফিরে মাথায় এসেছে, সেটা হলে কীভাবে জাপানি পুরুষেরা নিজেদের আচরণ এত সমৃদ্ধ করেছে? এর জন্য কি শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ না অন্য কিছু? আইনের শাসন বা শাস্তির চেয়েও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সামাজিক আচরণ শিক্ষার চেষ্টা। যেটা খুব ছোটবেলা থেকে পরিবার বা ডে কেয়ার সেন্টারের মাধ্যমে শিশুরা শিক্ষা পেয়ে থাকে। জাপানের প্রায় প্রতিটি শিশু ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সের মধ্যে ডে কেয়ারে যায় এবং সাত বছর পর্যন্ত অবস্থান করে। কারণ মনোবিদদের মতে, জন্মের পর থেকে সাত বছরের মধ্যে একটা শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তাই এ সময়ের শিক্ষাটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সে দেশের সরকার।
জাপানি শিশুরা আগে সামাজিক আচরণ বা আইনকানুন রপ্ত করে, তারপর স্কুলে যায়। এখানকার ডে কেয়ারে কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের দিনভর রেখে দেওয়ার মধ্যে যে শুধু সীমাবদ্ধ এমন নয়, একটি শিশুকে ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেব গড়ে তুলতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। দুই বছর বয়স থেকে শিশুদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক আচরণ শেখানো হয়। যা শিশুর বিকাশ বা ভবিষ্যৎ চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছোটবেলা থেকে যদি কোনো ভুল করে তবে তাদের বারবার বোঝানো হয়, এটা অন্যায়, ভবিষ্যতে আর এমন করা যাবে না। শিশু বলে ছাড় দেওয়া হয় না। আর যে জিনিসটা খুব ভালো করে শিক্ষা দেওয়া হয়, যেটা তোমার নয় সেটার ওপর কোনো অধিকার নেই। এ কারণে জাপানের শপিংমল বা হাসপাতালে অনেক খেলনা পড়ে থাকলেও কোনো শিশু কখনো সেটা নিতে বায়না ধরে না।
সুস্থ পরিবেশ ও শিক্ষার মধ্যে দিয়ে যখন কোনো শিশু বড় হয় তখন সে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য সহজে বুঝতে পারে। শিশুকাল থেকে অন্যকে সহযোগিতা করা, নারীদের সম্মান দেওয়া এসব শেখানো হয়। আর পারিবারিকভাবে নারীরা সমান সুযোগ পেয়ে বড় হয়। যে কারণে পুরুষেরা তাদের দুর্বল মনে করার কোনো সুযোগ নেই। আর রাস্তাঘাটে নারীদের হয়রানি করলে সোজা পুলিশ হাজির। সে জন্য আইনও কড়া।
নারীদের প্রতি শিশুকাল থেকে যেন অদম্য কৌতূহলের সৃষ্টি না হয় সে জন্য সর্বত্র সহশিক্ষা কার্যক্রম। খুব ছোটবেলা থেকে এরা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বন্ধুর মতো বড় হয়। আর জাপানি পুরুষেরা খুব সহজে কোনো মেয়ের সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলে না, সে যত সুন্দর হোক। যদি কোনো মেয়েকে ভালো লাগে তবে প্রেমের সম্পর্কে জড়াবে। এ ক্ষেত্রে কোনো জোর চলে না। আর না পেলে প্রতিশোধ পরায়ণও হয় না।
আর জাপানে আঠারো বছরের আগ পর্যন্ত কাউকে সিগারেট বা মদ খাওয়ার বা কেনারও সুযোগ নেই। আর অন্য কোনো মাদক আমদানি বা রপ্তানি নিষিদ্ধ। পরিবার যত ধনী হোক, কোনো অন্যায় করলে বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার সুযোগ নেই। কারণ আইন সবার জন্য সমান। আর বাবার অঢেল টাকা থাকলেও আঠারো বছরের পর সবাইকে নিজের খরচ চালাতে হয়। বাবার বিশাল অর্থ দিয়ে অনর্থ করার কোনো সুযোগ নেই।
এভাবেই জাপানি পুরুষেরা সামাজিক আচরণ শিক্ষা, পারিবারিক শাসন ও আইনের মাধ্যমে নিজেদের আচরণ সমৃদ্ধ করেছে। আর জাপানিরা জাতিগতভাবে সবাই কঠোর পরিশ্রমী। কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকার কারণে অন্যায় করার সুযোগ মেলে না।
আমাদের দেশেও যদি সামাজিক শিক্ষা, আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকত তাহলে কিছু পুরুষ সত্যিকারের মানুষে পরিণত হতো। যাতে সব মেয়ে নিরাপদে পথ চলতে পারত। জানি না আমাদের দেশে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।

উম্মে সালমা বাপ্পি: ইয়োকাহামা, জাপান।