বেচারা স্বামী-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জান একটু বসো তো, তোমার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়া আলোচনা করব—বউ মিষ্টি করে কথাগুলো বলল।

—এখন আমার পকেট পুরাই খালি, প্লিজ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়া এখন আমার সঙ্গে আলোচনা কইর না। আগামী মাসে দেখা যাবে।
—মানে কী! তুমি কি বলতে চাও আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা মানেই শপিং?
—না না তা কই নাই, মানে...।
—মানে মানে করবে না। ভেবেছিলাম ঠান্ডা মাথায় ভদ্রভাবে তোমারে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব। কিন্তু তুমিতো আর ভদ্র ব্যবহারের উপযুক্ত না। আমি খেয়াল করে দেখেছি, তুমি সব সময় সব জায়গায় বোঝাতে চাও যে, তুমি একজন আদর্শ হাসব্যান্ড। আর আমি একটা দজ্জাল স্ত্রী, তাই না?
—নাউজুবিল্লা। এসব কি কও? মনে যাই থাক, আমি কখনো এমন কথা কাউরে আমার মুখ দিয়া বলি নাই।
—তুমি তো মুখে কিছুই বলবে না। কারণ তুমিতো একটা ঘাগু। ইবলিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট।
—নাউজুবিল্লা নাউজুবিল্লা। আমার মতো সাদা দিলের মানুষরে ইবলিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট বইল না। মনে কষ্ট পাই।
—সরি আমার ভুল হয়েছে, আসলে তুমি তো ইবলিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট না, তুমি নিজেই ইবলিস। তুমি ইবলিস, তুমি ইবলিস, তুমি ইবলিস।
—আচ্ছা যাও আমিই ইবলিস। তিনবার বলার কোনো দরকার নাই। শোনো, আমি ইবলিস এটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হইল আমি ইবলিস হইলে তুমি তো ইবলিসের বউ, এটা কি খেয়াল করছ। বিষয়টা কি তোমার জন্য সম্মানজনক? তুমিই কও।
—আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সবার কাছে আমারে দজ্জাল বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এখন সাধু সাজা হচ্ছে না?
—কি সব বলতাছ, আমি আবার এই সব কখন করলাম।
—সেদিন আমার ছোট বোন আমারে ফোন করে কি কান্নাকাটিটাই না করল।
—দেখো তোমার বোন তোমারে ফোন কইরা কান্না করছে তাতে আমার দোষ কোথায়? আমি কি তারে কাঁদতে বলছি!
—তোমার কারণে ওর বান্ধবীরা এখন ওকে কত আজেবাজে মন্তব্য করছে? ও নাকি এখন লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারছে না।
—মাই গড, কও কী! সে কি প্রেগন্যান্ট? বিশ্বাস করো আমি কিছু করি নাই। আমার চরিত্র এতটা খারাপ না।
—তুই ব্যাটা একটা ইতর, তাই তোর চিন্তা ভাবনাও ইতরের মতো। আমি কি তোরে বলেছি আমার বোন প্রেগন্যান্ট? আর তুই করবি আমার বোনের সাথে খারাপ কিছু! ও তোরে ভোঁতা দা দিয়া কোপাইয়া পিচ পিচ কইরা সাজায়ে রাখবে।
—কও কী! ওরে দেখে তো এমন মনে হয় না। আচ্ছা তোমরা কি ডাকাত বংশীয়? আর কোপাকুপি কি তোমাদের বংশীয় ব্যবসা?
—খবরদার বংশ তুলে কথা বলবি না। বংশ নিয়া কথা বললে ভোঁতা বটি দিয়া এক কোপে তোর গলা নামায় দেব।
—শোনো কোপাইতে ইচ্ছে হইলে কোপাইবা। কিন্তু ভোঁতা দা বটি দিয়া কেন? দরকার হয় আমি বাজার থেকে নতুন বটি কিনে আনব। ওইটা দিয়া কোপাইও। আচ্ছা তোমরা কি সারা জীবন ভোঁতা দা বটি দিয়াই কাম করছ? ভালো দা বটি কখনো দেখো নাই। আর একটা কথা, সব সময় তুই তুই কইর না। স্বামীরে তুই কইরা বলা কিন্তু ঠিক না। এটা বিশাল গুনাহের কাজ। তোমার কিন্তু গুনাহ হইবে।
—গুনাহ হলে হোক। দরকার হলে তোরে তুই তুই বলতে বলতেই আমি দোজখে যাব। তুই একটা তুই তুই তুই।
—ঠিক আছে যাও আমি তুই। তোমার যখন দোজখে যাওয়ার শখ হইছে, দোজখেই যাও। খোদার দুনিয়ায় কোনো শখ অপূর্ণ রাখতে নাই। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমার বোনকে আমি কীভাবে কান্দাইলাম, সেটা তো বলবা।
—কাঁদবে নাতো কি করবে? তুমি জানো, তোমার কারণে ওর বান্ধবীরা ওকে বইমেলা থেকে দুটো বই গিফট করছে।
—আমার কারণে বই গিফট করছে? কও কি? কেন? একটু খুলে কও তো। তবে গিফট পাওয়া কিন্তু ভালো। তাও আবার বই। ওর তো আমারে ধন্যবাদ দেওনের কথা। তা না কইরা উল্টো কাঁদতেছে ক্যান?
—কারণ বইগুলো দিয়ে ওরা বলেছে, এই বইগুলো তোর বোনকে দিস। আর তোর বোনকে বলিস ভালো হয়ে যেতে।
—কও কী!
—আর বইয়ের নাম শুনবে? প্রথমটার নাম ‘স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত’, দ্বিতীয়টার নাম, ‘আদর্শ স্ত্রী হওয়ার ১০১টি কৌশল।’
—না, না এটা কিছুতেই মাইনা নেওয়া যায় না। ওদের এত্ত বড় সাহস। তোমার মতো আদর্শবান স্ত্রীরে ওরা আদর্শ স্ত্রী হওয়ার কৌশল শেখায়!
—টিটকারি মারবে না। তোমার জন্যই আজ এটা হয়েছে। গতকাল মা পর্যন্ত আমারে ফোন দিয়ে বলেছে, মারে স্বামীরে এত চাপে রাখিস না।
—বিশ্বাস করো আমি তোমার কথা কাউরে কই নাই। কারও সাথে শেয়ার করি নাই।
—বলবে কি, তুমি তো পেপারে গল্প লিখে পুরা বাংলাদেশের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছ তোমার বউ দজ্জাল। তুমি কষ্টে আছ, সুখে নাই।
—কবে? কেমনে?
—তুমি প্রথম আলো পত্রিকায় ‘বেচারা স্বামী’ নামে আমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা লিখো নাই?
—ও তাই কও। ওইটা তো একটা গল্প।
—হ্যাঁ তোমার ওই গল্পের জন্যই সবাই আমারে এখন মায়া হাজারিকা মনে করে।
—উনি আবার কে? এই ভদ্রমহিলাকে তো চিনলাম না। তোমার কোনো আত্মীয়?
—উনি বাংলা সিনেমার সবচেয়ে কুটনি, আর খারাপ মহিলা ভিলেন। যেটা এখন আমি। গতকাল পাশের বাসার ভাবি আমারে একটা সিডি দিয়েছে শোনার জন্য। আমি ভাবলাম পুরোনো দিনের বাংলা গানের সিডি। ওমা, বাজিয়ে দেখি ওয়াজ মাহফিল।
—দেখো আমিতো কিছু মিন কইরা গল্প লিখি নাই। এমনি মজা কইরা লিখছি। তুমি জানো, ওই গল্প পইড়া অনেক পাঠক কিন্তু ‘আমাদের ভালোবাসা অমর হোক’ এমন মন্তব্যও করছে।
—মিথ্যা বলবে না। আমি দেখেছি কী লিখেছে। বেশির ভাগই নেগেটিভ মন্তব্য। মন্তব্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে আমি রওশন জামিল।
—এ আল্লাহ ইনি আবার কে?
—উনিও মহিলা ভিলেন।
-তাই নাকি? আরে তোমার তো দেখি সব মহিলা ভিলেনের সঙ্গেই পরিচয় আছে।
-এর মানে কি? তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ?
-প্লিজ সব কথা ধইর নাতো। আর শোনো আমি তো গল্পের মধ্যে তোমার আসল রূপ তুইলা ধরিনি। তোমারে অনেক ভালোভাবে উপস্থাপন করছি।
-তার মানে তুমি বলতে চাও, আমার আসল রূপ আরও ভয়ংকর? আরও খারাপ?
-এ আল্লাহ আমারে উঠায়ে নাও। এ মহিলা দেখি আমি যে কথাই কই সেটাই ধরে! মন দিয়ে শোনো। ফেসবুকে অনেকে মজা করে অনেক মন্তব্য করে। ওটা ধরবা না। কিন্তু যখন কেউ মেইল করে কোনো মন্তব্য করে, সেটা ধরবা। কারণ সেটাই হইতাছে আসল মন্তব্য। তুমি জানো, মেইল করে অনেকে অনেক ভালো ভালো মন্তব্য করছে।
-তাই নাকি? একটু শোনাও, দেখি কী এমন অমৃত বলেছে। টিটকারি মেরে বউ কথাগুলো বলল।
-আসলেই শুনবা?
-হ্যাঁ শুনব। কি ভয় পেয়েছ না? তা তো পাবেই। কারণ তুমিও জানো কেউ ভালো কিছু লেখেনি।
-আরে না লিখছে। যেমন একজনে লিখছে টম অ্যান্ড জেরি, একজনে লিখছে মিষ্টি মধুর ঝগড়া, একজনে লিখছে..।
কথাটা শেষ করতে পারলাম না, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ফোনে ইনকামিং ম্যাসেজ রিংটোন বেজে উঠল।
-ওই দেখো তোমার ফোনে নতুন মেসেজ এসেছে, নিশ্চয় তোমার লেখা নিয়ে কেউ আবারও মেসেজ পাঠিয়েছে।
-আরে বাদ দাও তো, যার যা খুশি পাঠাক আমাদের কী।
-বাদ যাবে কেন। তুমিই না বললে পাঠকেরা মেসেজে যে মন্তব্য করে সেই মন্তব্যই প্রকৃত মন্তব্য। ফোনটা আমারে দাও, পড়ে দেখি কী লিখেছে। বলেই বউ হাত বাড়াল ফোনটি নেওয়ার জন্য।
-আরে না, দাঁড়াও আমিই পড়তাছি।
-তুমি পড়বে কেন, আমি কি অশিক্ষিত? আমাকে পড়তে দাও।
বউ ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা মনে মনে পড়ল। তারপর আমার দিকে ফোনটা ছুড়ে মেরে চিৎকার করে বলে উঠল, আজ থেকে সব রান্না বন্ধ। তোর মতো বদলোকের রান্না আমি করব না।
কথাগুলো বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে দুটো চুলাই বন্ধ করে দিল। চুলার ওপরে তখন আধা রান্না ভাত আর তরকারি।
কী পড়ে বউ এমন চেতল জানার জন্য মেসেজটা পড়লাম। কামাল নামে এক পাঠক লিখেছেন-‘ভাই ভাবিয়াছিলাম সামনেই বিবাহ করিব। কিন্তু আপনার লেখা পড়িয়া সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রয়োজনে বিষ খাইব, গলায় দড়ি দিব, তবুও বিবাহ করিব না। আমার মাথায় ঢুকে না, আপনি এই দজ্জাল স্ত্রী নিয়া এখনো বাঁচিয়া আছেন কীভাবে? ভাই কাবিন কি খুব বেশি? বেশি না হইলে এই দজ্জাল স্ত্রীকে ছাড়িয়া দিন। আর যদি খুব বেশি হয় এবং আপনার সামর্থ্য না থাকে, তাহা হইলে জানান। প্রয়োজনে আমরা পাঠকেরা আপনার জন্য চাঁদা তুলিব। আল্লাহ আপনাকে এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করুন, আমিন।’
মেইলটা পড়ে বুঝলাম, আজ খবর আছে। মনে মনে বললাম, ভাই কামাল কামডা কি করলেন? আমারে সমবেদনা জানাইতে গিয়া তো আমার বারোটা বাজায়ে দিছেন। কইতে পারেন, এখন আমি কি খেয়ে বাঁচুম?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এটি একটি কাল্পনিক কাহিনি। এর সঙ্গে বাস্তবের কারও কাহিনির কোনো মিল নাই। বিশেষ করে আমার বউয়ের সঙ্গে তো প্রশ্নই আসে না।
আশা করি এবার বউ আর চেতব না। আল্লাহ ভরসা।

ইমদাদ বাবু: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।