টোকিওর বৈশাখী মেলা ১৫ এপ্রিল রোববার

টোকিও বৈশাখী মেলার প্রচারপত্র
টোকিও বৈশাখী মেলার প্রচারপত্র

জাপান প্রবাসীদের প্রাণের মেলা টোকিও বৈশাখী মেলায় শুধুমাত্র টোকিওপ্রবাসী নন, দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার প্রবাসীর সমাবেশে মুখরিত হয়ে ওঠে। সবাই প্রতীক্ষায় থাকেন দেখা সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য।

শুরুটা হয়েছিল প্রায় দেড় যুগ আগে। একেবারে আনকোরা আয়োজনে জাপানপ্রবাসীরা হল ভাড়া নিয়ে কংক্রিটের দেওয়ালের ভেতর বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করতেন। শুধু টোকিও নয়, অন্যান্য বড় বড় শহর তথা ওসাকা, কিওতো, হিরোশিমা, নাগাসাকি ও সেন্দাইয়ে প্রবাসীরা ছোট ছোট হল ভাড়া করে দিনটি উদ্‌যাপন করতেন। মূলত এই আয়োজনের উদ্যোগীরা ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা৷
মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষাভাষীরা নিজস্ব মানচিত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই চেতনা নিয়ে প্রবাসেও তারা কিছু করতে চান টোকিওর ইকেবুকুরো রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম এক্সিট সংলগ্ন একটি পার্কে (ইকেবুকুরো নিশিগুচি কোয়েন)। সেখানে ‘বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল’ নাম দিয়ে পর পর দুটি অনুষ্ঠান আয়োজনের পর ১৯৯৯ সালে জাপান বাংলাদেশ সোসাইটি নামক একটি সংগঠন বাংলাদেশপ্রেমী জাপানি বন্ধুদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একই পার্কে শুরু করে টোকিও বৈশাখী মেলা। পরবর্তীতে এই মেলার সাথে ‘কারি ফেস্টিভ্যাল’ নামটিও সংযোজন করে নতুন রূপে নামকরণ করা হয় ‘বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভ্যাল’৷
ওৎসুবা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় জাপান বাংলাদেশ সোসাইটি ও বৈশাখী মেলা উদ্‌যাপন কমিটি সকল রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্রীড়া সংগঠন ও প্রবাসী মিডিয়া কর্মীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সাধারণ প্রবাসীদের নিয়ে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে প্রায় ১৮টি আয়োজন সফল করতে সক্ষম হয়েছে৷ আগামী ১৫ এপ্রিল রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৯তম টোকিও বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভ্যাল ২০১৮।

টোকিও বৈশাখী মেলার ফাইল ছবি
টোকিও বৈশাখী মেলার ফাইল ছবি

প্রবাসে বসেও প্রবাসী বাঙালিরা মাতৃভূমির ভালোবাসায় গড়ে তুলতে চান আপন সংস্কৃতি বলয়। আর তারই সফল আয়োজন টোকিও বৈশাখী মেলা। সারা বিশ্বে প্রবাসীরা বৈশাখী মেলা আয়োজন করলেও জাপানপ্রবাসীরা এই মেলাকে কেন্দ্র করে একটি অসাধ্যসাধন করতে সক্ষম হয়েছেন। তা হচ্ছে এই মেলার মাঠেই তারা মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতীক ২১ ফেব্রুয়ারি এবং আন্তরজাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্মারক শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করেছেন। টোকিওর প্রাণকেন্দ্র মর্যাদাবান ইকেবুকুরো ন্যাশনাল থিয়েটার সংলগ্ন পার্কে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের শহীদ মিনার৷ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের করা এটাই প্রথম শহীদ মিনার৷ এই বিজয়টি অর্জন করতে প্রেক্ষাপট হিসেবে নেপথ্যে ছিল বৈশাখী মেলার প্রতি বছরের সফল আয়োজন৷ বৈশাখী মেলা সফলভাবে উদ্‌যাপিত হয় বলেই জাপান কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনার নির্মাণের অনুমতি দিতে কার্পণ্য করেনি৷
জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের কেন্দ্রবিন্দু ইকেবুকুরো এলাকায় জাপানের জাতীয় ফুল ফুটন্ত চেরির ছায়াতলে যেন নিশ্চিন্তে বুক ফুলিয়ে গর্ভের সঙ্গে দণ্ডায়মান বাংলা ভাষার প্রতীক বহির্বিশ্বের প্রথম শহীদ মিনার।
জাপান প্রবাসীদের প্রাণপ্রিয় এই মেলাকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকেন৷ সারা জাপানে এখন প্রবাসী বাংলাদেশির সর্বমোট সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। মেলার দিন প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি, কিছু জাপানি ও কিছু ভিনদেশি প্রবাসীর সমাবেশ ঘটে৷ দূর দূরান্ত থেকে প্রবাসীরা ছুটে আসেন এই একটি দিনের আনন্দে শরিক হতে৷ মেলা উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আসেন দেশসেরা সংগীত শিল্পী, লেখক-সাংবাদিক ও সম্পাদককেরা। হাজারো প্রবাসীর সমাগমে টোকিও বৈশাখী মেলাটি জাপানে প্রবাসীদের এযাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ কর্মকাণ্ড বলে বিবেচিত। টোকিও বৈশাখী মেলা মানে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, দেশি খাবারের স্বাদ গ্রহণ, বছর ধরে জমে থাকা ক্লান্তি অবসানের সমাপ্তি। আর বাংলাদেশের কারিকে জাপানিদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাটিও কম নয়৷

টোকিও বৈশাখী মেলার ফাইল ছবি
টোকিও বৈশাখী মেলার ফাইল ছবি

এই মেলাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে মেলা কমিটির সবাই প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন৷ জাপানের কঠিন আইন-কানুন রীতিনীতি মেনে চলে মেলাকে সফল করার জন্য মেলা কমিটি অবশ্যই প্রশংসনীয়৷
দিন দিন মেলায় জাপানিদের সমাগম লক্ষ্য করার মতো। টোকিওর বুকে এক দিনের এক টুকরো বাংলাদেশকে দেখে জাপানিরা অবাক হন, বাংলাদেশকে তারা চেনেন নতুন পরিচয়ে৷
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন: ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী—কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’
টোকিও বৈশাখী মেলা প্রবাসীদের দেশপ্রেম আর হৃদয়ে বাংলা সংস্কৃতি লালনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার একটি তাৎপর্যময় আয়োজন। হৃদয়ে, মননে তাই তার অস্তিত্ব থাকে চিরঞ্জীব৷
স্বাগত টোকিও বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভ্যাল ২০১৮।

কাজী ইনসানুল হক: টোকিও, জাপান। ইমেইল: <[email protected]>