অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নই উন্নয়ন নয়

নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে দেশকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে নিয়ে ও ভালোবেসে, দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়া।
নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে দেশকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে নিয়ে ও ভালোবেসে, দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়া।

টেলিভিশনের পর্দায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখলে আমার চোখ নড়ে না। স্থির হয়ে থাকে কান দুটিও। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি তাঁর বক্তব্যগুলো। তাঁর বক্তব্যের কোনো কিছুই বাদ দিতে মন চায় না। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী একটি খুশির সংবাদ পৌঁছে দিলেন আমাদের যে, বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল একটি দেশ। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের প্রোফাইলে এখন বলা আছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা এ বছর মার্চ মাসেই অর্জন করেছে বাংলাদেশ। যদিও আমরা অনেক আগে থেকেই দেশকে উন্নয়শীল দেশ হিসেবে বিবেচনা করতে দেখেছি। তবুও সংবাদটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশিদের জন্য আনন্দের।

কিছুদিন আগে ৭ মার্চ উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ টেলিভিশনের পর্দা থেকে কানে ভেসে এসেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সেই অংশে ছিল আরও একটি সুখবর। ওই সুখবরটির সারমর্ম, প্রধানমন্ত্রী আশাবাদী বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হবে। শুনে মনটা তখন আনন্দে ভরে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনটা নিজের সঙ্গে নিজে যুদ্ধ শুরু করল। কারণ, মনের কোণায় উঁকিঝুঁকি দিতে থাকল একাধিক প্রশ্ন।
প্রশ্নগুলো ছিল, উন্নত দেশের সংজ্ঞা কি? একটি দেশের উন্নয়নের মানদণ্ড কীসের ওপর ভিত্তি করে নিরূপণ করা হয়? সেখানে কি জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের নিরপেক্ষতাও কি বিবেচিত হয়? দৈনন্দিন জীবনে দেশের সাধারণ জনগণের বাক্‌স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িকতা কি পরিমাপ করা হয়? নাগরিকদের মাথাপিছু আয় গণনার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের জাতীয়তাবাদ ও মূল্যবোধ গণনা করা হয় কি? শিক্ষার মানও কি একটি দেশের উন্নয়নের মানদণ্ডের সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা সাধারণ ভাষায় এমন, উন্নত দেশ বলতে ওই সকল সার্বভৌম দেশকে বোঝায়, যারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উচ্চতর প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর সর্বোচ্চ স্তর বা নির্দিষ্ট সীমারেখায় অবস্থানসহ স্বল্পোন্নত দেশসমূহ থেকে অনেকাংশেই এগিয়ে রয়েছে। অথবা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে ও এই উন্নয়ন দীর্ঘ মেয়াদে অব্যাহত আছে এমন দেশকে বলে উন্নত দেশ।
এই অর্থে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে উন্নয়নের মানদণ্ডের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান উন্নত দেশের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, ‘A developed country is one that allows all its citizens to enjoy a free and healthy life in a safe environment. (অর্থাৎ উন্নত দেশ বলতে, যে সকল দেশ তার নাগরিকদের মুক্ত ও নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তাসহ উপযুক্ত পরিবেশ, স্বাস্থ্যকর জীবন প্রদানে সক্ষম তাকে বোঝায়)।
সে ক্ষেত্রে একটি দেশের উন্নয়নের মানদণ্ডের সূচক কিন্তু অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বাইরেও বিস্তৃত। অর্থাৎ একটি দেশের উন্নয়নের মান নির্ভর করে, দেশটির অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি সেই দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের ওপরও। দেশটির নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বাক্‌স্বাধীনতা, ধর্ম ও লিঙ্গ নিরপেক্ষতা, পরিবেশের বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তার ওপর।
এ ছাড়া কোনো দেশের মুদ্রামানের স্থিতিশীলতা, শিল্প খাতের পাশাপাশি সেবা খাত ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদ উন্নত দেশের অন্যতম মাপকাঠি।
আমাদের বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে সত্যি। নাগরিকদের মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আধুনিক হাসপাতাল হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো কতটা মানসম্মত? আমাদের দেশের সরকার কি একবারের জন্যও এই প্রশ্নটি করেছেন? কিংবা নিজেরা এই সকল উন্নয়নের মান নিয়ে ভেবেছেন?
বাংলাদেশের মুদ্রার মান এখনো দিনদিন কিন্তু হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রমাণ ১৯৯৪-১৯৯৫ সালে মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল প্রায় ৪০ টাকা। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৮০-৮৫ টাকায়। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সেটা যেমন আমি স্বীকার করি, তেমনি এও মানি, এখনো আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছেন যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মানও হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষাপদ্ধতি এখন গৃহশিক্ষক, নোট বই, গাইডবই, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাৎসরিক আয়ের ব্যাপারে যতটা সচেতন, তার অর্ধেকও যদি সচেতন হতো শিক্ষার মানের প্রতি, তবে দেশে শিক্ষিত জঙ্গি হতো না। আর আধুনিক হাসপাতালগুলোকে ডাক্তারদের বিনিয়োগের উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে না। সেখানে এখন আর কোনো শিশু স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয় না। সবাই অপারেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর আলো দেখে। মৃত রোগীকে লাইফ সাপোর্টে রেখে হাসপাতালগুলো মোটা অঙ্কের বিল করে, সাধারণ অসুখেও রোগীকে আইসিইউতে রাখার নাম করে রোগীকে তার আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে রেখে তাদের মানসিক যন্ত্রণায় রাখছে। কখনো এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে চেপে রাখে বছরের পর বছর।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য সব বিষয়ে সরকারকে দোষারোপ করব না। আমাদের অর্থাৎ নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে। নিজের দেশকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে নিয়ে, দেশকে ভালোবেসে, দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়া। তবে যেহেতু এখনো আমাদের দেশের বেশির ভাগ জনগণ দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা শব্দটির প্রকৃত অর্থ বোঝেন না ও এর তাৎপর্য মনেপ্রাণে ধারণ করতে ব্যর্থ সেহেতু সরকারের দায়িত্ব বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার ব্যবস্থা করা।
এরপর নারীদের নিরাপত্তার অভাব। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়, নারীরা ঘরে ও বাইরে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। এমনকি কখনো কখনো ধর্ষণের পর তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। নারীরা নিরাপদে ঘরের বাইরে যেতে পারেন না, ভ্রমণ করতে পারেন না। এর কারণ অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না বলে অন্যরাও অপরাধ করতে ভয় পায় না আর। সঠিক বিচারের অভাবে অপরাধীদের ক্রমাগত অপরাধের শিকার হয়ে অসংখ্য নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদ্রাসা পাস ছাত্রদের সরকারি চাকরিও দেওয়া হচ্ছে। অথচ কোনো মাদ্রাসাই শিক্ষার্থীদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ শেখানোর প্রয়োজন মনে করে না এবং শেখায় না। গত বছর একাত্তর টেলিভিশন চ্যানেলের স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানকার শিক্ষার্থীরা জানে না জাতীয় সংগীত কি? স্বাধীনতা দিবস কি? ভাষা দিবস কি? অথচ বাংলাদেশের ভাষা দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেখানকার শিক্ষার্থীরা জানে না, ২৫ মার্চের প্রকৃত ইতিহাস। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে তারা জাতীয় সংগীত গায় না, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে দেখে না। হয়তো একটু নিখুঁতভাবে খোঁজ করলে দেখা যাবে, সেখানে স্বাধীনতার পক্ষের জনগণকেই শত্রু বলে শেখানো হচ্ছে। এগুলো তাদের পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ তারা শুরু থেকে শুরু করে এখনো পাকিস্তানি ভাবধারা সমর্থন করে। এখন প্রশ্ন হলো, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কি সরকারি কোনো পদে থেকে উন্নত একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং নিজের দেশ ও বিশ্বকে সেবা দেওয়ার জন্য আদৌ প্রস্তুত? তাদের কি পর্যাপ্ত যোগ্যতা আছে? তাদের প্রতিদিন জাতীয় সংগীত গাইতে বাধ্য করা হয় না কেন? তাদের কেন বাধ্যতামূলকভাবে দেশের প্রকৃত ইতিহাস শেখানো হয় না?
নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতির পাশাপাশি দেশের জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, স্থায়ীভাবে সাম্প্রদায়িকতা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। যেদিন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক নিজের দেশে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ মনে করবেন, নিজের বাক্‌স্বাধীনতা ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা পাবেন, সেদিন দেশটি আপনাআপনিই নব্বই শতাংশ উন্নত দেশে উন্নীত হবে। আমরা আশা করছি, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা, নারী নিরাপত্তা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে সরকার ব্যাপকভাবে এবং সঠিক উপায়ে কাজ করবে। শুধু লোক দেখানো নয়, সকল সমস্যার গোড়া থেকে সমস্যাগুলো নির্মূল করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবেই আমাদের বাংলাদেশ প্রকৃতভাবে উন্নত দেশে উন্নীত হতে পারবে।

খুরশীদ শাম্মী: টরন্টো, কানাডা।