ছিন্নমূল

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বসন্তের এক ঝলমলে বিকেল। সানফ্রানসিসকো। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিমে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এক মনোরম শহর। শীতের শেষ আমেজটুকু যাই যাই করছে। পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোটুকু রেস্টুরেন্টের কাচের বড় জানালা দিয়ে তানহাদের টেবিলে এসে পড়েছে। তানহার জন্মদিন। ওর সেদিন ১২ বছর হলো। নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হচ্ছে। তানহা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, খুব আদরের। তবে ওদের পরিবারে কোনো কিছু নিয়েই খুব বাড়াবাড়ি নেই। তাই এত দামি রেস্টুরেন্টে খেতে আসাটা ওদের জন্য প্রতিদিনের অভ্যাস নয়, বরং একটি বিশেষ ঘটনা। তানহার ইতালীয় খাওয়া খুব পছন্দ। ওর বান্ধবী রোজের কাছ থেকে এই দোকানের নাম শুনেছে। তারপর থেকেই অপেক্ষা করছে কবে আসবে। বাবা বলেছে ওর জন্মদিনে নিয়ে যাবে।

অনেক উৎসাহ নিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় এক ঘণ্টা দূরের এই রেস্টুরেন্টে ওরা খেতে এসেছে। ওর মা সামিনা খুব সুন্দর করে সেজেছেন। বাবা-মা আর তানহা যখন হইচই করে ঢুকছিল তখন রেস্টুরেন্টের দরজার পাশে বসে থাকা এক হোমলেস (ছিন্নমূল) মানুষের ওপরে ওর চোখ আঁটকে যায়। রেস্টুরেন্টের দরজার পাশেই তাঁর অস্থায়ী আবাস। প্লাস্টিকের বিশাল ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি হাবিজাবি। সেই সঙ্গে একটা টায়ার। তাঁকে দেখেই তানহার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বাবা-মার আনন্দ দেখে ও মন খারাপ ভাবটা চেপে রাখল।
টেবিলে বসে ওরা গল্প করছিল। বাবা অনেক হাসির হাসির গল্প বলছিলেন। ওরা যেখানে বসেছে সেখান থেকে সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। ব্যস্ত এই শহরটি পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে। ওদের চোখের সামনে শহরের চেহারা পাল্টাচ্ছে। শহরটি যেন আরও জমজমাট হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে রেস্টুরেন্টের সামনে লম্বা লাইন। ভাগ্যিস ওরা আগেই এসেছিল। বাবা-মা আর তানহা মিলে খাবার অর্ডার দিল। খাবারের দাম দেখে মা মনে হলো একটু চিন্তিত হয়ে গেছেন। নিজের জন্য শুধু সালাদ অর্ডার করলেন। টেবিলে ওর আর বাবার পছন্দের ধোঁয়া ওঠা লোভনীয় খাওয়া এসে পৌঁছেছে। সঙ্গে মায়ের আকর্ষণীয় সালাদ। খাবার সার্ভ করার সময় তানহার বাবা স্বভাবসুলভভাবে ঘোষণা দিলেন তার খাওয়ার ভাগ তিনি কাউকেই দেবেন না।
ওদের পুরো পরিবারই ভীষণ ভোজনরসিক। সবাই যখন খাবার ওপরে হামলে পড়েছে, তানহার চোখের সামনে সেই ছিন্নমূল লোকটির মুখটা ভেসে উঠল। খাওয়ার মাঝপথে বাবা-মাকে সে বলেই ফেলল, জানো, দরজার পাশেই একজন হোমলেস বসে আছে। আমরা এখানে এত মজা করে খাচ্ছি, আর ও হয়তো সারা দিন কিছু খায়নি। তানহার গলার স্বর শুনেই বাবা-মা বুঝে গেলেন যে ওর মন খারাপ। পরিবেশটা একটু ভারী হয়ে গেল। ওরা যেটা ভাবছিলেন তানহা সেটাই বলে ফেলল—বাবা, আমাদের এই খাবার বাকিটা ওকে দিয়ে দিতে পারি?
তানহার বাবা শাহেদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন মেয়ের সামনে। বাকিটা বলতে আসলে যা আছে, সেটা দিয়ে দিলে তাদের এখন পেট খালি রেখে না খেয়ে বের হয়ে যেতে হবে। এত শখ করে পরিবার নিয়ে খেতে এসেছেন, এ রকম জায়গায় সব সময় আসা হয় না। তা ছাড়া, এত উঁচু দরের রেস্টুরেন্ট, এই ছিন্নমূলকে ঢুকতেও দেবে না। খাবার দামও অনেক বেশি। সাত-পাঁচ ভেবে এবং স্বভাবের বিরুদ্ধে মেয়েকে বোঝাতে শুরু করলেন, মা, তুমি তো জানো এখানে সু-এর কত ভয়। ওকে এই খাওয়ার অবশিষ্ট অংশ দিলে ও যদি অসুস্থ হয়, ও কিন্তু আমাদের সু করতে পারে। তানহা খুব যে ভালো বুঝল বা একমত হলো তা নয়, একটু গাঁইগুঁই করে মেনে নিল। শাহেদের কিন্তু মনটা খারাপ হয়েই রইল। মেয়েটা তাঁর মতো স্বভাব পেয়েছে। পথেঘাটে কাউকে কোনো কষ্টে দেখলেই তার সাহায্য করতে ইচ্ছে করে, না পারলে কষ্ট হয়।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা।
ওরা ছুটি কাটাতে বের হয়েছে। টানা কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে শাহেদ ভীষণ ক্লান্ত। সবাই প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ওরা একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢুকল। খাবার অর্ডার করে আর কারও তর সইছে না। মনে হচ্ছে খিদেয় পেটের নাড়িভুঁড়ি শুদ্ধ হজম হয়ে যাবে। সবাই প্রায় নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। নীরবতা ভাঙল তানহা।
বাবা, দোকানের বাইরে একজন বুড়ো লোক বসে আছে, ও আমাদের মতো হাংরি।
এটুকু বলেই তানহা আর কিছু বলল না।
তানহার মা সামিনার খুব ক্লান্ত লাগছে। ওদের কথার মাঝখানেই উঠে গেল বাথরুমে, একটু চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে।
বাথরুম থেকে এসে দেখে টেবিলে মেয়েটা একা বসা।
তোমার বাবা কোথায়?
মেয়ের চোখ অনুসরণ করে দেখল শাহেদ আরও খাওয়ার অর্ডার করছে, সঙ্গে একজন বুড়ো লোক। পোশাক আশাক নোংরা, শত ছিন্ন। মুখ ভর্তি সাদা, ধুলোমাখা দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল। দেখেই বোঝা যায়, তার বাড়িঘর কিছুই নেই।
মা, তুমি অনেক ভাগ্যবান। তুমি এমন একজন স্বামী পেয়েছ যার একটা বিশাল হৃদয় আছে।
মেয়ের কথায়, সামিনার চোখের কোণায় পানি চিকচিক করে। মেয়েটা কবে এত বড় হয়ে গেল? মায়ের সব সিক্রেটগুলো বুঝে যায় নিজে নিজে। ততক্ষণে শাহেদ ফিরে এসেছে। মুখে তৃপ্তির হাসি।
শাহেদ বলল, লোকটা মাত্র একটা মিল নিয়েছে, একটা ডাবল চিজ বার্গার, কোক আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। ভীষণ খুশি মনে হলো।
তানহা জানে বাবার কেমন খুশি লাগছে, বড় হয়ে সে বাবার মতো কোনো হাংরি মানুষ দেখলেই খাওয়াবে।
মেয়ে আর বাবার খুশি দেখে সামিনা তাড়াতাড়ি চোখের পানি লুকোতে চেষ্টা করে। জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু কি চাওয়ার আছে?

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।