স্মৃতির পাতায় অমর একুশে বইমেলা

চিলেকোঠা উপন্যাস হাতে লেখিকার প্রিয়জনেরা
চিলেকোঠা উপন্যাস হাতে লেখিকার প্রিয়জনেরা

অসংখ্য বইপ্রেমীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে শেষ হলো অমর একুশে বইমেলা ২০১৮। প্রাণের এই মিলনমেলা প্রতিটি বইপ্রেমীর কাছেই অনেক বেশি প্রিয়। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়েই বইমেলা যেন পাঠক হৃদয়ে উৎসবের ঝড় তোলে। সেই ঝড়ের তাণ্ডবে মাতোয়ারা হয়ে সবাই ছুটে যান প্রাণের মেলা বইমেলায়। বইমেলা আলোর মেলা আর সেই আলোর মিছিলে শামিল হতে পাঠক সমুদ্রে পরিণত হয় পুরো মেলা প্রাঙ্গণ।

আমার মতো যারা তীব্রভাবে আক্রান্ত বই রোগে, তাদের জন্য বইমেলা যেন একটা মস্ত বড় ঔষধালয়। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ মনের সকল ব্যাধিকে মুহূর্তেই সারিয়ে তোলে। সেই জন্যই বইমেলা প্রাণের মেলা।
আমরা যারা হতভাগা প্রবাসী বই রোগী, বইমেলার এই সময়টায় প্রবাসে বসে বই চিকিৎসার অভাবে মুমূর্ষু অবস্থায় জীবন যাপন করি। যদিও প্রবাসে উন্নত চিকিৎসার কোনো অভাব নেই, তবুও আমাদের রোগের একমাত্র চিকিৎসা কেবল বইমেলা। মেলা চলাকালে যারা প্রবাসে থাকেন কেবল তারাই বোঝেন এ সময়টা তাঁদের ভেতরটা কতটা পোড়ায়! তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকি নীল-সাদা দুনিয়ায়। প্রিয় স্বদেশে যখন প্রিয়জনদের মেলায় শামিল হতে দেখি, তখন দূর থেকেই না পাওয়ার ব্যথা কিছুটা ভোলার চেষ্টা করি।
এবারের বইমেলা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্মৃতিবিজড়িত বইমেলা। কারণ, এবারের বইমেলায় আমার নিজের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠা’ প্রকাশিত হয়েছে ত্রয়ী প্রকাশনী থেকে। এ ছাড়া বিশজন সম্ভাবনাময় লেখকের গল্প ও কবিতায় সমৃদ্ধ সংকলন ‘বৃত্ত’ প্রকাশিত হয়েছে শিখা প্রকাশনী থেকে। একই সঙ্গে দুটি স্বপ্ন পূরণের অভিজ্ঞতা হওয়ার সৌভাগ্য এবারের বইমেলায় আমার হয়েছিল।

লেখিকার উপন্যাস চিলেকোঠা
লেখিকার উপন্যাস চিলেকোঠা

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রবাসীর খাতায় নাম লেখানোর কারণে বিগত বছরগুলোর মতো এবারের বইমেলাতেও সশরীরে অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়নি। জীবন থেকে আমিহীন আরও একটি বসন্ত প্রাণের মেলাকে সাথি করে হারিয়ে গেল। রেখে গেল মধুর কিছু স্মৃতি! অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও আমার বইমেলায় যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল! তবে এবারের বইমেলা বিদায়ের বেলা মনে কোনো বিষাদের ছায়া ফেলতে পারেনি। পারেনি ধূসর রঙে ছেয়ে ফেলতে আমার কল্পনার ক্যানভাস! এ বছরের বইমেলা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় একটি বইমেলা। আমার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূর্ণতার স্বাদ পেয়েছে এ বছরের বইমেলায়। বইমেলা ২০১৮ আমার স্বপ্ন পূরণের বইমেলা! আমার প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠা এবং সংকলন বৃত্ত এবারের বইমেলায় স্থান করে নিয়েছে।
বইমেলায় উপস্থিত থেকে নিজের লেখা প্রথম ছাপা অক্ষরের বই দুটি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। প্রবাসে বসে এ নিয়ে আমার হৃদয়ে আক্ষেপও কম ছিল না! কিন্তু সব প্রত্যাশা প্রাপ্তির দুয়ারে পৌঁছায় না! বিধাতা কিছু স্বপ্ন অধরা রেখে দেন। হয়তো আরও ভালো কিছু উপহার হিসেবে দেবেন বলে! জীবনে ছোট ছোট অপূর্ণতা থাকে বলেই আমরা পূর্ণতাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। যদিও আমি আমার প্রথম উপন্যাসটি স্পর্শ করতে পারিনি কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে যখন আমার প্রিয়জনেরা আমার প্রথম স্বপ্নকে তাদের ভালোবাসার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দিয়েছেন, তখন অপূর্ণতা নামক শব্দটি আমার কাছে কোনো প্রশ্রয়ই পায় না। বইমেলার শুরু থেকে শেষ অবধি আমার প্রিয়জনেরা আমাকে বেঁধে রেখেছেন প্রাণের মেলার গহিনে। একটি বারের জন্য আমাকে উপলব্ধি করতে দেননি আমার অনুপস্থিতি। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে জীবনে?
আমার প্রথম প্রচেষ্টাকে সফল করতে সবাই আমার পাশে ছিলেন। আমাকে অনুপ্রেরণা দিতে কেউই একবিন্দু কার্পণ্য করেননি। মেলা চলাকালে যখন দূর পরবাস থেকে দেখতাম, আমার কাছের মানুষগুলো শত ব্যস্ততার মাঝেও মেলায় গিয়ে আগ্রহের সঙ্গে পরম মমতায় আমার বইটি সংগ্রহ করেছেন এবং বইটি হাতে নিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে উৎসাহিত করছেন, তখন মনের অজান্তেই এক সমুদ্র তৃপ্তির জল গড়িয়ে পড়ত দুই চোখ বেয়ে! যার ঝুলিতে এত এত মানুষের ভালোবাসা, সে কখনো নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না! আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ! আমি কল্পনাও করিনি, আমার চিলেকোঠা সবার ভালোবাসায় এভাবে কানায় কানায় ভরে উঠবে। প্রিয় মানুষেরা দূর পৃথিবীর আমাকেও তাদের ভালোবাসার বৃত্তে বন্দী করবেন! এভাবেই সকলের ভালোবাসায় আমৃত্যু সিক্ত হতে চাই। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন দূর পরবাসে বসেও বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারি।

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।