স্ট্যানফোর্ডের আকাশ

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন। ছবি লেখক
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন। ছবি লেখক

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হাঁটছি। বিকেলের স্ট্যানফোর্ড অসম্ভব সুন্দর। সারি সারি পাম ট্রি। সবুজ ঘাস। পুরোনো পুরোনো ভবন। স্ট্যানফোর্ডের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন বাংলাদেশি গবেষক সাইফুল ইসলাম। নিয়ে গেলেন তার গবেষণাগারের দিকে। ব্যাকম্যান রিসার্চ সেন্টার। সেই সেন্টারের সামনে থরে থরে উৎকীর্ণ করা আছে কত কত বিজ্ঞানীদের সাফল্যগাথা। কোনটা ফেলে কোনটা পড়ব অবস্থা। সে পথে হাঁটলেই শরীরে কেমন শিহরণ জাগে। ছুঁয়ে দেখা যায় জগৎখ্যাত সেই সব মানুষদের পদচিহ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান অংশ হলো ইস্ট কোস্ট ও ওয়েস্ট কোস্ট। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরের অংশকে বলা হয় ইস্ট কোস্ট। ওয়েস্ট কোস্ট বলা হয় প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী অংশকে। এই দুই তীরেই দেশটির সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইস্ট কোস্টে আছে এমআইটি, হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, কর্নেল, ইউপ্যান ও কলম্বিয়া। ওয়েস্টকোস্টে আছে ক্যালটেক, স্ট্যানফোর্ড, ইউসি-বার্কলে, ইউসি-এলএ (ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস) ইত্যাদি। দুই তীরের এই শহরগুলো হলো দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। আর এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

ক্যালিফোর্নিয়া হলো আমেরিকার ওয়েস্টকোস্টের শহর। সেখানে গড়ে উঠেছে সিলিকন ভ্যালি। গড়ে উঠেছে শত শত বায়োটেক কোম্পানি। ব্যবসা-বাণিজ্য, টেকনোলজি এই সবের এক জীবন্ত নগরী হলো ক্যালিফোর্নিয়া। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হচ্ছে সেখানে। নতুন নতুন আইডিয়া, উদ্ভাবন, প্রচার, প্রসার, বাণিজ্য—এই চলছে। ওয়েস্ট কোস্টের শহরগুলো যেন নিদ্রাহীন। রাত-দিন সব সময়ই জীবন্ত।

ক্যালিফোর্নিয়া ও তার আশ-পাশের শহরগুলোকে বদলে দিয়েছে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেগুলোর মধ্যে স্ট্যানফোর্ড, ক্যালটেক, ইউসি-বার্কলে, ইউসি-এলএ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হাজার হাজার মেধাবী তরুণেরা বেরিয়ে পড়ছেন সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের মাথায় সেরা সেরা আইডিয়া। যে যার মতো নানান বিষয়ে ভাবছেন। সেই ভাবনা কাজে লাগাচ্ছেন। আর এই ভাবনার উৎস কি?-উন্নত শিক্ষা ও গবেষণা!

স্ট্যানফোর্ডের ছেলেমেয়েরা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত নয়। সেখানের ছেলেমেয়েদের নোংরামি শেখানো হয় না। হল দখল করা, হলে ফ্রি খাওয়া, মিছিল-মিটিং, র‍্যাগিং এগুলো শেখানো হয় না তাদের। তাদের জগৎ জয়ের কথা শোনানো হয়। সেই পথ দেখানো হয়। তাদের দেওয়া হয় আধুনিকতম শিক্ষা। তারা ব্যস্ত প্রজেক্ট নিয়ে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম নিয়ে। তারা ব্যস্ত গবেষণা নিয়ে। সারা দুনিয়ার গবেষকেরা আসছেন সেখানে। লেকচার দিচ্ছেন। ভাবনার আদান-প্রদান হচ্ছে প্রতিদিন। এই তো তাদের কাজ! তাদের শিক্ষকেরা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত নয়। শিক্ষকেরা তাদের চাকরি টিকিয়ে রাখতে দিন-রাত খেটে মরছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নেতারা দখল করে রাখেনি সেখানে। মেধাবীদের ভয়ে নেতারা কাঁপছেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বসে বসে রাজনৈতিক কলাম লেখা নিয়ে ব্যস্ত নন। নিজের প্রতিষ্ঠানকে কী করে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরা যায়, সে নিয়েই কাটে তার সকাল-সন্ধ্যা।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। বিকেলের ক্যাম্পাস। ছবি: লেখক
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। বিকেলের ক্যাম্পাস। ছবি: লেখক

শিক্ষার্থীরা শুধু পড়ছে, গবেষণা করছে আর জীবনকে উপভোগ করছেন। তাদের কোনো শঙ্কা নেই। নেই কোনো সংকোচ! ক্ষুদ্র জগতে ওরা নিজেদের বন্দী করে রাখে না। তুচ্ছ রাজনৈতিক পদের লোভে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কে অন্যের কাছে তুলে দেয় না। নেতাকে পুছতে গিয়ে, নিজের মেধা ও সম্ভাবনাকে বিকিয়ে দেন না। কুড়ির তরুণ, ব্যাচেলর শেষ করে নিজের প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছেন। একুশের তরুণ গবেষণায় উন্মুখ হয়ে আছেন। বাইশের তরুণ তার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ইউরোপের কোনো দেশে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে গবেষণা করছেন। নতুন নতুন ভাষা শিখছেন ছেলেমেয়েরা। প্রোগ্রামিং শিখছেন। পঁচিশ-ছাব্বিশের ছেলে-মেয়েরা হরহামেশা পিএইচডি শেষ করে দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার ভাবনায় বিভোর হয়ে আছেন। আমাদের মতো আদুভাই বানিয়ে, ওদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করানো হয় না।

সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কত বিচিত্রতা। বহু জাত, ধর্ম, ভাষা ও জাতীয়তার তরুণেরা সেখানে মিলিত হয়েছেন জ্ঞানান্বেষণে। কোনো মারামারি নেই। রাজনীতি আর দলীয় পরিচয় নেই। সেসব পরিচয়ে বড় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মগজকে কাজে লাগিয়ে যারা থাকতে পারবেন তাদের জন্যই সেসব ক্যাম্পাস। লড়াইটা শুধু মগজের বলেই, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে জগৎ কাঁপানো মানুষ। মাথা ছাড়া অন্য কোনো পরিচয়ে বড় হওয়ার কোনো উপায় নেই সেখানে।

স্ট্যানফোর্ডে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এল। তাতে সেখানের আলো কমে না এতটুকু। সে আকাশে কান পাতলেই শোনা যায় ফিসফিস করছে ওরা। যাদের জন্য পৃথিবী আজ এত দূর। কত কত নাম সে তালিকায়। তাদের সৃষ্টির কিরণে সে আকাশ চির উজ্জ্বল! অন্ধকারের সেখানে নেই প্রবেশ!

ড. রউফুল আলম: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>