নৈঃশব্দ্যের প্রহর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুর, বাড়িটার সামনে এসে আমি একটু দাঁড়ালাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও চিন্তা করলাম ভেতরে ঢুকব কিনা।

হাতে আমার সে মানুষটার জন্য কেনা ছোট্ট একটা উপহার।
আজ তার জন্মদিন। অনেক ভেবেই আজ আসলাম, যা বোঝাপড়া আজকেই করতে হবে।
বেল বাজিয়ে দরজায় অপেক্ষা করতে লাগলাম।
একটু পরে তাদের কাজের লোক এসে দরজাটা খুলে বলল কাকে চাই?
আমি বললাম নয়নকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে।
লোকটা বলল ভাইয়া তো বাসায় নাই, আচ্ছা একটু দাঁড়ান, এই বলে সে ভেতরে চলে গেল।
একটু পর দেখি নয়নের বড়ভাই আসল, আমার কাছে জানতে চাইল আমি কে?
তিনি বললেন, তুমি নয়নের সঙ্গে পড়, এসো ভেতরে এসো।
আমি জানতে চাইলাম ওর খবর কি, তার সঙ্গে আজ ছয় মাস কোনো যোগাযোগ নেই, সে ফোন করে না, আমি করলেও দেখি মোবাইল বন্ধ দেখায়।
নয়নের বড়ভাই খুব শান্ত স্বরে বললেন, সে ভালো আছে, প্রতিদিন ভার্সিটি যায়, ক্লাস করে। আর তোমাদের এখন যে বয়স নিজেদের ভালো মন্দ বোঝার যথেষ্ট সময় হয়েছে, পড়াশোনা করো।
আমি তাকে উপহারগুলো এগিয়ে দিয়ে বললাম, আজ ওর জন্মদিন তাই এগুলো এনেছিলাম, ওকে একটু বলবেন আমি এসেছিলাম। এরপর আর একটুও অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলাম।
আড়চোখে খেয়াল করে দেখলাম তাদের বিত্তবৈভব, সামাজিক অবস্থান, তাহলে এতদিন ধরে কানে যা আসত তা সব সত্যি ছিল। সে যখন বুঝতে পেরেছিল আমি খুব সাধারণ একটা ঘরের মেয়ে তাই হয়তো তার মন আর এগোতে সায় দেয়নি, সে নতুন মানুষে ডুবে আছে এখন।

এবার আমার কথা বলি।
আমি নীলা, খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা সব ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ সামলাতে হিমশিম খান, তাই কিছু টিউশনি করি নিজের পড়াশোনার জন্য।
প্রতিদিন টিউশনিতে যাওয়ার সময় একটা দোকানে নীল রঙের একটা জামা পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু আমি কিনিনি। ভেবেছিলাম ওর জন্মদিনের গিফট কিনে নেই তারপর না হয় কিনে নেব নিজের জন্য।
যাক, এই সব ভেবে আর কাজ নেই। বুঝেই তো গেলাম সব শেষ।
আমিও মুক্ত হলাম। যা কিছু পিছুটান আমার তোমার প্রতি ছিল তা ছুড়ে দিয়ে এলাম তোমাদের অর্থ-বিত্তের কাছে।

ঠিক সাত বছর পরের ঘটনা।
নিউইয়র্ক সিটির ঝকঝকে রাস্তা ধরে একটি মেয়ে হাঁটছিল। দুই চোখ ভরে সে দেখছিল আর ভাবছিল এই শহরটা এত সুন্দর কেন। মাত্র মাসখানেক হলো নীলা এই শহরে এসেছে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সের স্কলারশিপ নিয়ে।
স্টারবাকসের কফিশপে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে কাপাচিনো কফিটা সে নিল, আর চুমুক দিয়েই বুঝতে পারল কেন এই কফিটা এত বিখ্যাত।
দেশের বন্ধুদের সঙ্গে তার যোগাযোগ, আড্ডা সব চলে ফেসবুকে।
বিকেলে ক্লাস শেষ করে সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোয় সে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। দেখে তাকে বন্ধু হওয়ার রিকোয়েস্ট করেছে নয়ন। বহুদিন পর স্মৃতির পাতাটা ভারী ঠেকে তার কাছে।
টুপ করে সে ডুবে যায় স্মৃতির মায়াজালে। সেদিন নয়নের বাসা থেকে বেরিয়ে চোখের পানি মুছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল আর নিজেকেই বলেছিল তোমার জন্য এই আমার শেষ কান্না। এরপর আমি আর কখনোই কাঁদব না। আমি কেন কাঁদব, এই সম্পর্ক গড়া ও ভাঙায় আমার তো কোনো দায় নেই।
কিন্তু এইটুকুতেই তা কি শেষ হয়েছিল?
উম্ হু, তা হয়নি।

আমি চলে আসার এক বছর পরে তুমি আবার আমাকে ফোন দিলে। বললে যা করেছ ভুল করেছ আবার ফিরে আসতে চাও তুমি।
আমার উত্তরটা খুব সাধারণ ছিল না, কখনোই না। ততদিনে নিজেকে খুব শক্ত করে গড়ে নিয়েছি আমি। সে অস্থায়ী সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে আর কষ্ট পেতে চাই না আমি।
কত কিছু মনে পড়ে গেল আমার। এই সাত বছরে অনেক বদলে গিয়েছি আমি। মন ভাঙা আর গড়ার খেলা এসব এখন আর আমাকে ভাবায় না। শক্ত হাতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের বাটনে গিয়ে ডিলিট বাটনটা চাপি।
আমার নৈঃশব্দ্যের প্রহরগুলোয় যখন তোমায় কাছে পাইনি তাই আর দরকারও নেই কোনো কিছুতে তোমায়। তুমি ওই দূরের ল্যাম্পপোস্টের ছায়াটার মতো। আমার জীবনজুড়ে সেই ছায়ার প্রভাব যেন কখনোই আর না পড়ে।
ভুল তো মানুষ একবারই করে বারবার তো আর নয়।

রিফাত নওরিন: আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র।