সরকারি চাকরি: বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ

সরকারি চাকরি
সরকারি চাকরি

ভাগ্যের সন্ধানে বিদেশে আসার পর জীবনের অনেকগুলো দিক অন্যভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। পড়াশোনা আপাতত শেষ করে চাকরিতে যোগদানের পর ভেবেছিলাম, এবার হয়তো বাঁচলাম। কিন্তু না, পড়াশোনা চলছেই। একটু ভিন্নভাবে। জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে। রাজ্য সরকারের অধীনে কাজ করার সুবাদে দেখলাম এরা কীভাবে নতুন কিংবা অভিজ্ঞ প্রার্থীদের বিভিন্ন পদের জন্য বাছাই করে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই কিছুটা লেখার ইচ্ছা অনেক দিন ধরেই। ২০১৫ সালে দেশ ছাড়ার পর বিগত সময়ে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তেমন বেশি পরিবর্তন আসেনি। আর এই কারণেই আজকের এই লেখাটা লিখতে বসা। বাংলাদেশ প্রশাসন যদি তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনতে চায়, তারা পরীক্ষামূলকভাবে টেনেসি রাজ্য সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে।

গত বছরের শেষের দিকে একদিন আমার সুপারভাইজার আমাকে ডেকে বললেন, টেনেসি টেক ইউনিভার্সিটিতে একটা প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সুযোগ আছে, যদি আমি উৎসাহী হই। ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড টেস্ট ডিভিশন ও অ্যারোনটিকস ডিভিশনের প্রতিনিধিদের এই প্রেজেন্টেশন দেওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছে। পরে জানলাম, আমাদের সেকশনে একজন অনভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া হবে। বিভাগের অন্য ডিভিশনের মধ্যে অ্যারোনটিক্যালেও সমমর্যাদার একজন ইঞ্জিনিয়ারের পদ খালি আছে। এই দুই পদের জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে কিছু প্রার্থী টেনেসি টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলেন, ট্রান্সপোর্টেশন ডিপার্টমেন্টের তো ট্রাফিক প্লানিং অথবা রাস্তা বানানোর কাজ করার কথা। সেখানে ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড টেস্ট ডিভিশন কিংবা অ্যারোনটিকসে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেবে কেন? দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত না হয়ে শুধু চাকরি করার জন্য যেন কেউ না আসে সেটা নিশ্চিত হওয়া মানবসম্পদ বিভাগের জন্য জরুরি। ঠিক এ কারণেই আমাদের পাঠানো হচ্ছিল ব্যাপারটা খোলাসা করতে। আমরা গিয়েছিলাম এই দুই ডিভিশনে আমরা কী কী করি, কেন করি এবং রাজ্যের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখায় আমাদের ভূমিকা কতটুকু সেটা বলার জন্য। এই প্রেজেন্টেশনের আরও একটু উদ্দেশ্য হচ্ছে নিয়োগ প্রতিযোগিতায় ওই প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

টেনেসি টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক
টেনেসি টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক

এই রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগে আলাদা মানবসম্পদ বিভাগ আছে, কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তারা কোনো প্রার্থীর ইন্টারভিউতে উপস্থিত থাকে না। যে অফিসের জন্য প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে, সে অফিসের কর্মকর্তারা এই নিয়োগে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। মানবসম্পদ বিভাগ চাকরিপ্রার্থীদের আবেদনপত্র সংশ্লিষ্ট অফিসে পাঠিয়ে দেয় যাচাই বাছাইয়ের জন্য। শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে এখানে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর কিছু বিষয়ভিত্তিক (১০ থেকে ১২টি) প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে প্রার্থীদের দ্বিতীয় পর্বের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। আবেদন থেকে দ্বিতীয় পর্বের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা, সবকিছুই অনলাইনে হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় পর্বেও কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ বিভাগের কোনো ভূমিকা থাকে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই এই ইন্টারভিউ নিয়ে থাকেন। এই ইন্টারভিউ বোর্ড সাধারণত পদবির ভিত্তিতে ঠিক করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যে পদের নিয়োগ হবে তার সুপারভাইজার, সমমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট সেকশনের ম্যানেজার, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ওই ডিভিশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এই ইন্টারভিউ বোর্ডই ঠিক করবে তাদের অফিসের জন্য কোন প্রার্থী সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।
সাম্প্রতিক সময়ে এই সাক্ষাৎকার অনলাইনে (টেলিকনফারেন্সিং) সম্পন্ন করার সুবিধা চালু করা হয়েছে। প্রার্থী চাইলে ঘরে বসেই এই ইন্টারভিউ সম্পন্ন করতে পারেন। বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ বিভাগ প্রার্থীদের চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়। আবেদনপত্র গ্রহণ করা থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত সময় লাগে বড়জোর দুই মাস।
বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের এই উদাহরণটা অনেক বেশি কার্যকরী হবে বলেই আমার বিশ্বাস। চট্টগ্রামের একটা অফিসের নিয়োগ দেওয়ার জন্য যদি ঢাকা যেতে হয় প্রিলি, রিটেন ও ভাইভা দেওয়ার জন্য, তাহলে চূড়ান্ত নিয়োগে বছরখানেকে সময় তো লাগবেই। আঞ্চলিক অফিসগুলোতে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলে অফিস প্রতি প্রার্থীর সংখ্যা যেমন অনেক কমে আসবে; তেমনি বর্তমান লোকবলেই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। যেমনটা হচ্ছে আমার বর্তমান কর্মস্থলে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ডিজিটালাইজড প্রযুক্তিও প্রয়োগ করা যায়। কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাদের উচিত এ দিকে একটু বিশেষ নজর দেওয়া। তাহলে নিয়োগে দুর্নীতিও কমে আসবে। সময়ও কম লাগবে। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কোনো ঝুঁকি থাকবে না।
কারিগরি ক্ষেত্রে পড়াশোনাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থী অনার্সে কোন বিষয়ে পড়াশোনা করেছে, এই ব্যাপারটা এখানে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। চার বছরের পরীক্ষার ফলাফলের অনেক মাহাত্ম্য। এই দিকটা এখানকার লোকজন ভালোভাবেই অনুধাবন করেন। বাংলাদেশে এই দিকটা অবহেলার চোখে দেখা হয়। চাকরিতে প্রবেশের জন্য ব্যাচেলরস কিংবা মাস্টার্সের সার্টিফিকেট যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হয়, তাহলে বাংলাদেশেরে নিয়োগ ব্যবস্থায় কেন এই সার্টিফিকেটের বিষয় অথবা ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না?
একটা কথা বাংলাদেশের নিয়োগ বাজারে সব সময় চলে, সবাই বাবা-মায়ের ইচ্ছায় অনার্সের বিষয় ঠিক করে; চাকরির ক্ষেত্রে সে জন্য অনার্সের বিষয় বাদ দিয়ে সাধারণ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে আলাদা নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হয়। যাতে প্রার্থী তার পছন্দমতো কাজের ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে পারে। বাংলাদেশের নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাস এই ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক? আসলেই কি প্রার্থীরা তাদের পছন্দের কাজের ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছেন? নাকি সরকারি চাকরির জন্য অনার্সের পড়াশোনা বাদ দিয়ে যেভাবেই হোক নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করার চেষ্টা চালাচ্ছে? অধ্যাকেরা চার বছর ধরে একটা শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে একটা ফলাফল দেন। বাংলাদেশি নিয়োগকর্তাদের উচিত এই ফলাফলকে আরেকটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
এটা সত্য যে, আমেরিকা ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য। পার্থক্যের বিশালত্বের কারণে বাংলাদেশকে রাতারাতি আমেরিকা বানানো সম্ভব নয়। এদের মধ্যে তুলনা চলে না। তবে বাংলাদেশ চাইলে উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করতে পারে। সব বিষয়ে উন্নত দেশকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে পরিবর্তন আনা অতীব জরুরি। আজকে থেকে যদি অনুসরণ শুরু করে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশেরও অবস্থার পরিবর্তন হবে।

ফিরোজ রশিদ: ন্যশভিল, টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্র। লেখক কুয়েট এবি এসসি ও আরকানসা স্টেট (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে এমএসই সম্পন্ন করে বর্তমানে টেনেসি ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টেশনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত।