রসায়ন ল্যাবে চোখ থাকুক নিরাপদে

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

চোখ প্রতিটি মানুষের জন্যই এক মহামূল্যবান সম্পদ। চোখ যে শুধু পথ দেখার জন্য, তা নয়। এই চোখ নাকি মনের কথাও বলে। এই চোখ দুটিই যদি নিরাপদে না থাকে, পথ চলা তো দূরে থাক মনের কথাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রসায়ন ল্যাবে চোখের নিরাপত্তা বিষয় নিয়ে বলছি।

রসায়ন বিষয়টি প্রাণের সঙ্গে কতটুকু ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা আমাদের দেশীয় অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও উল্লেখযোগ্য গবেষণা না থাকার কারণে এই বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় পিছিয়ে থাকলেও প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থীকে এ বিষয়ে উচ্চ-শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করছে। রসায়ন বিষয়ে দেশীয় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হলেও স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত নয়। এ কারণে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে পিএইচডি করার জন্য দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার পরও ইউরোপ-আমেরিকা বা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আবার স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) করার প্রয়োজন পড়ে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই একটি নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন যারা ইউরোপ-আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চতর গবেষণার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরেন। আবার বহির্দেশে অনেকের যথেষ্ট সুনামও রয়েছে। উন্নত দেশের রসায়ন ল্যাবরেটরিতে নিরাপত্তা বিষয়ে সবাই কমবেশি অবগত। আমাদের দেশে উন্নত দেশের মতো রসায়ন ল্যাবে নিরাপত্তার সব দিক অর্থনৈতিক কারণে নিশ্চিত করা না গেলেও কিছু বিষয় শিক্ষকদের সুনজরে নিশ্চিত করা যায়।

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

আমাদের দেশের প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) রসায়ন ল্যাবে নিরাপত্তাবিষয়ক একটি মাত্র যে নিয়ম মানা হয় তা হলো ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় ল্যাব কোট পরিধান করা। অথচ গত চার বছরে আমি আমেরিকায় আমার দেখা কোনো আন্ডারগ্র্যাড রসায়ন ল্যাবে কাউকে ল্যাব কোট ব্যবহার করতে দেখিনি। শুধুমাত্র রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে ল্যাব কোট পরা হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন আমেরিকার রসায়ন ল্যাবরেটরিগুলোতে মানা হয়, যা আমাদের দেশে একটিও মানা হয় না।
সাদা ল্যাব কোট আমাদের দেশের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের ফ্যাশন বলা যায়। রসায়ন বিভাগে আন্ডারগ্র্যাড ল্যাবগুলোতে নিরাপদ চশমা বা সেফটি গোগলের (Goggle) তুলনায় ল্যাব কোটের গুরুত্ব কতটুকু, সে বিষয়ে আমাদের দেশের সকল বিদেশ ফেরত রসায়নের শিক্ষকেরা সম্যক অবগত। অনার্স প্রথম বর্ষের সল্ট অ্যানালাইসিস আর আগুনের শিখা নিয়ে কাজ থেকে শুরু করে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত রসায়ন বিভাগে সব বর্ষেই কম বেশি কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা হয়। 12M ঘনমাত্রার অ্যাসিড নিয়ে কাজ করা হয় কিনা জানি না, তবে ন্যূনতম 0.5M ঘনমাত্রার অ্যাসিড তো থাকেই। নানা ধরনের ক্ষারের (base) ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য কেমিক্যালের ব্যবহার হয় সর্বদা। অ্যাসিড-বেজ ছাড়াও যেকোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থের একটি ফোঁটা চোখে পড়লে যে কারও চোখে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে মুহূর্তেই। এমন পরিস্থিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চোখে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা আমাদের নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে দেখেছি ল্যাব কোট না পরলে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ল্যাব থেকে বের করে দিতেন। এই ল্যাব কোট দিয়ে আমরা কোন মূল্যবান অঙ্গটির প্রতিরক্ষা করি? আমাদের শার্ট, প্যান্ট, নাকি চামড়া? তাহলে আমাদের চোখ দুটিকে কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, এই নিয়ে কি আদৌ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে কোনো সচেতনতা আছে? এক ফোঁটা অ্যাসিড চামড়ায় পড়লে কী হবে আর চোখের মণি বা চোখের নিচের স্পর্শকাতর চামড়ায় পড়লে কী হবে একবার কি কেউ অনুমান করতে পারেন?
আরেকটি ব্যাপার হলো, কোনো কারণে যদি চোখে মুখে কেমিক্যাল পড়েই যায় উন্নত দেশের মতো তৎক্ষণাৎ চোখে–মুখে নিরবচ্ছিন্ন পানি মারার জন্য যে অবকাঠামো দরকার সেটা আমাদের নেই। এ কথা সত্য। তবে ল্যাবে নিরাপত্তার জন্য খোলা স্যান্ডেল না পরে সম্পূর্ণ পা ঢেকে রাখে এমন জুতো পরে আসার নিয়ম সহজেই করা যায়। আমাদের দেশে যেকোনো রসায়ন ল্যাব শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন জানার জন্য কোনো ক্লাসও হয় না। অথচ কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করার আগে সবার জীবন রক্ষার্থে নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন জেনে রাখা খুবই প্রয়োজন।

লেখক
লেখক

রসায়ন ল্যাবে চোখের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ধরনের চশমা ব্যবহার করা হয় যাকে বলে সেফটি গোগল। এটি দুই ধরনের হয়। একটা হলো Splash goggle, আরেকটি সাধারণ সেফটি গোগল। আমেরিকার অধিকাংশ আন্ডারগ্র্যাড ল্যাবে Splash goggle ব্যবহার হয়। এর বিশেষত্ব হলো, এটি অনেকটা ডুবুরিদের ব্যবহৃত গ্লাসের মতো। কেমিক্যালের ঝটকা মুখে এসে পড়লেও চোখ ছুতে পারবে না। আর সাধারণ সেফটি গ্লাসগুলো চার পাশে খোলা থাকে, তবে কেমিক্যাল সরাসরি চোখে যেতে পারবে না, তবে পাশ দিয়ে যেতে পারে।
আমেরিকায় রসায়ন ল্যাবগুলোতে নিরাপত্তা খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। এখানে নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন খুব কঠোরভাবে মানা হয় এবং সবগুলো নিয়ম না মানলে ল্যাবে কাজ শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয় না। আরও কিছু জরুরি নিয়ম হলো, মেয়েরা ল্যাবে চুল ছেড়ে আসতে পারবে না। এমনভাবে প্যান্ট পরতে হবে যা পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে রাখে। যাতে কোনো কেমিক্যাল চামড়া স্পর্শ না করে। প্যান্টে কোনো ফ্যাশনজনিত ছিদ্র থাকা চলবে না। ল্যাবে কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার চলবে না আর মেয়েদের চুল সব সময় বেণি করে বা বেঁধে আসতে হয়। অবাক করা বিষয়, আমাদের দেশের আন্ডারগ্র্যাডের রসায়ন ল্যাবে নিরাপত্তাবিষয়ক ল্যাব কোট পরা ব্যতিরেকে আর একটি নিয়মও মানা হয় না। অথচ আমেরিকায় আন্ডারগ্র্যাড ল্যাবে কেউ ল্যাব কোট পরে না।
রসায়ন বিষয়টিকে বলা হয় সেন্ট্রাল সায়েন্স। কারণ এটি ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োলজি, ন্যাচারাল সায়েন্স সবকিছুর মাঝে যোগসূত্র তৈরি করে। এ জন্য এ সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের রসায়ন তাত্ত্বিক বিষয়াদি ও ল্যাবরেটরিতে কাজ করার প্রয়োজন হয়। অনেকে জীবনে হয়তো একবারই একটি কোর্স নিচ্ছে আর হয়তো নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তারা জানেন না কোন কেমিক্যাল শরীরে বা চোখে কোন ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। ল্যাবে না থাকে নিরাপদ জুতা, না থাকে সেফটি গোগল, থাকে শুধু সাদা রঙ্গের ল্যাব কোট। বিশেষ নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মকানুন জানার জন্য কোর্সের শুরুতে কোনো ধারণাও দেওয়া হয় না।
আশার কথা, ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মনির উদ্দিন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশে প্রথমবারের মতো রসায়ন বিভাগে আন্ডারগ্র্যাড নতুন ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের ল্যাব কিটের সঙ্গে সেফটি গোগল দেওয়ার নিয়ম করেছেন এবং Safety of hazards in chemical laboratory বিষয়ক একটি কোর্স চালু করেছেন, যা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনুকরণীয়।
রসায়ন বিষয়টি প্রাণের সঙ্গে সম্পর্কিত। রসায়ন ল্যাবরেটরিতে দুর্ঘটনায় অবহেলাজনিত কোনো কারণে চোখ বা শরীরের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিসাধন করে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু রসায়নবিদ হওয়ার কোনো অর্থ নাই। আমাদের দেশের বিদেশ ফেরত ও নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মের সঙ্গে পরিচিত শিক্ষকদের সৎ উদ্যোগ ব্যতীত অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়ে রসায়ন ল্যাবরেটরিতে কাজ করে যাবে।

রেজাউল হক নাঈম: পিএইচডি শিক্ষার্থী, পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েস্ট লাফায়াতে, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <www.facebook.com/nayeee1m>