কেমন যেন মায়া পড়ে থাকে

লেখিকা
লেখিকা

আচমকা একদিন ড্যানিয়েল প্রশ্ন করে বসে, বলত কত বছর যাবৎ আমরা প্রতিবেশী? আমি খানিক পেছনের কালে ফিরে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম। বললাম, এক যুগ তো হবেই। কিংবা তারও বেশি। ড্যানিয়েল ধূসর ঘোলাটে চোখ বড় বড় করে বলল, চৌদ্দ বছর। ছোট্ট এই জীবনে চৌদ্দ বছর দীর্ঘ সময় বটে!

আমার পাশের দোতলায় থাকেন আইরিশ স্বামী-স্ত্রী দুজন। সন্তান নেই। ড্যানিয়েলের স্ত্রী নীল নয়না। অসম্ভব রূপবতী ছিলেন একসময়। বোঝা যায়। ছিলেন এই কারণে বলছি, তাঁরা দুজনেরই সত্তরের ওপরে বয়স। বয়সের ছাপ মুখের চামড়ায় স্পষ্ট। কিন্তু দৈহিক গঠনে বেশ শক্ত সামর্থ্য যুবক-যুবতী যেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই প্রচণ্ড স্বাস্থ্য সচেতন। খুব ভোরে বড় ছেলেকে নিয়ে আমি যখন ট্রেন স্টেশনের দিকে ছুটি, সেই আধো অন্ধকারে কনকনে শীতে ড্যানিয়েলকে ট্রাউজার পরে জগিং করতে, দৌড়াতে দেখি প্রায়ই। আমায় রোজ গুড মর্নিং বলতে ভোলেন না তিনি। বাড়ি ফিরে আমি যখন আবার ছোট ছেলেকে নিয়ে স্কুলের দিকে যাই, ততক্ষণে বাইরে দিনের আলো স্পষ্ট। উঁচু উঁচু দালান, গাছের মগডালে সকালের নরম রোদ ঝুলে থাকে। সেসময় ড্যানিয়েলকে ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে উবু হয়ে সাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যেতে দেখা যায়।

গাড়ি পার্কিং সংক্রান্ত কারণে অন্য প্রতিবেশীদের তুলনায় এই যুগলের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ও যোগাযোগ একটু বেশি। ওদের স্বামী-স্ত্রী দুজনের দু'টি গাড়ি। কিন্তু গ্যারেজ একটি। অন্যদিকে আমাদের গাড়ি তিনটি, কিন্তু গ্যারেজ দুটি। আমরা দুই পরিবারই একটি করে গাড়ি নিয়ে বিপাকে। বাড়তি গাড়িটি রাস্তায় পার্ক করতে হয়। বাড়ির সামনের রাস্তায় একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রাখা আমাদের দুজনের জন্যই সুবিধাজনক। ড্যানিয়েল ও আমি পালা করে সেখানে নিজেদের গাড়ি পার্ক করি। কখনো আমায় সেখানে দেখলে ড্যানিয়েল জানালা দিয়ে গলা বের করে উচ্চ স্বরে জানতে চায়, তুমি কখন বের হবে? আমি সময় বলি। নির্দিষ্ট সময়ে তিনি তাঁর গাড়িটি নিয়ে এসে হাজির হন। আমি যাওয়ার পর সেখানেই তাঁর গাড়ি পার্ক করা চাই।

এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় খানিক মন খারাপের স্বরে ড্যানিয়েল জানান, জানো তো কাল সারা রাত তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল, সুনসান নীরব রাস্তায় কেউ আমার গাড়ির কাচ ভেঙে কিছু জরুরি জিনিস চুরি করে নিয়েছে।
আমি বেশ বিস্মিত হয়ে বলি, বলো কী, এত বছর এই এলাকায় থাকি, চুরি তো হতে শুনিনি কখনো!
ঠিক পরের উইক এন্ডে সকালের কোনো এক সময়ে একই স্থানে রাখা আমার গাড়ির জানালার কাচ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। ভেতরে নজর যেতেই দেখি সাউণ্ড সিস্টেম খুলে নিয়ে গেছে কেউ। আমরা ম্যানেজমেন্টে অভিযোগ করলে দ্রুততম সময়ে বিল্ডিংয়ের চারপাশের সকল অকেজো সিসি ক্যামেরা খুলে নতুন ক্যামেরা লাগানো হয়। দেয়ালে সতর্কবার্তা টানানো হয়।
ড্যানিয়েল ও আমার, দিনে একাধিকবার আসা-যাওয়ার এমন কাটাকুটির সময়ে কথা হয় প্রায়ই। এক পড়ন্ত বিকেলে সাইকেল চালিয়ে কাজ থেকে ফিরেছেন সবে। আমায় লনে হাঁটতে দেখে কাছে এগিয়ে এসে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দাঁড়ান। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি, এনিথিং রং? বললেন, রেড সিগন্যালে অন্য সব গাড়ির সঙ্গে তাঁরও থেমে থাকবার কথা ছিল। একটু তাড়া থাকায় এবং ডানে–বাঁয়ে কোনো গাড়ি না থাকায় সতর্কতার সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুলিশ দেখে ফেলেছে ও জরিমানা করেছে।
এর কিছুদিন পর ভরদুপুরে জরুরি কাজে বাইরে যাওয়ার সময় দেখি আমাদের দুজনের নিয়মিত পার্কিংয়ের স্থানে বিশাল এক ভ্যান গাড়ি। দুমদাম শব্দে মালপত্র তুলছে কিছু সুঠামদেহী স্প্যানিশ যুবক। ড্যানিয়েল তদারকিতে ব্যস্ত। বিস্ময়ে তাকাতেই বলে ওঠেন, চলে যাচ্ছি নিউইয়র্ক ছেড়ে। এই শহর আমার জন্য নয়। এখানে জীবন কঠিন। প্রতিযোগিতামূলক ও ব্যয়বহুল। তারপর ভারী জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোন বের করে কী সব টাইপ করলেন। ফোনটি সামনে এগিয়ে আমাকে দেখালেন। দেখি, সেখানে গুগলে সার্চ দেওয়া—হাউ ফার ইজ অ্যারিজোনা ফ্রম নিউইয়র্ক। পাশেই মানচিত্রে লেখা, ২৩৩০ মাইলস।
অদূরে পার্ক করা গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে থেমে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি ড্যানিয়েল হাসি হাসি মুখে আবারও ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কেন যেন আচমকা মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠল। বলতে মন চাইল, ‘তোমরা যেও না।’ মানুষ এক স্থান ছেড়ে অন্য স্থানে আবাস গড়ে, নতুন করে ঘর সাজায়, আবারও সেখানকার সবকিছুকে আপন করে নেয়। বারবার এমন আপন করে নেওয়া যায় কিনা জানি না। কিন্তু আমি এমনটি মেনে নিতে পারি না। সবকিছুর জন্য কেমন যেন মায়া পড়ে থাকে। গাছপালা, ঘাস, বেলকনি, ইটের দালান সব, স-ব। আর মানুষের স্থানতো তারও অনেক ঊর্ধ্বে।
সম্পর্কগুলো মায়ায় থাকুক, যত্নে থাকুক।

রিমি রুম্মান: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।