ভালো থাকবেন রিপন ভাই

লেখক
লেখক

‘আপনি আর বাইরে যেতে পারবেন না।’ নির্লিপ্ত মুখে বললেন ইমিগ্রেশন অফিসার।

কি বলেন? আমার ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হয়ে গেছে তো। ফ্লাইটের আরও ২ ঘণ্টা বাকি।
‘ইমিগ্রেশনের পরে আর বাইরে যাওয়া যায় না।’ তাঁর চেহারা এখনো ভাবলেশহীন।
প্লিজ ভাই, দুইটা মিনিটের জন্য বাইরে যেতে দেন। আমি আমার আব্বা-আম্মার কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নিইনি। তাঁদের শুধু বলেছি কাউন্টারে আমার লাগেজ জমা দিয়ে বাইরে আসছি। আমার বন্ধুরাও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।
‘এখান থেকে সরেন তো। আপনাকে কয়বার বললাম বাইরে যাওয়া যাবে না। ভিসা ক্যানসেল করে দিই এরপর বাইরে যান।’
ভেতরে এসির কেশ ঠান্ডা থাকা সত্ত্বেও দরদর করে ঘামা শুরু করলাম। তার মানে আমার ফ্যামিলির কেউ জানবেও না আর। আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি কাউকে কিছু না বলে। মোবাইলটাও নেই সঙ্গে। কীভাবে কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। কেন যে বন্ধুর কথা শুনতে গেলাম ইমিগ্রেশনের পরেও বাইরে যাওয়া যায়! রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। অপেক্ষারত যাত্রীরা সবাই ফোনে কথা বলছেন। একজন ফোন রাখতেই দৌড়ে গেলাম তার কাছে।
—ভাই আপনার ফোন দিয়ে একটা ফোন করা যাবে?
—চার্জ নাই।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। এদিক-ওদিক দেখা শুরু করলাম। আরও দু-একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। একজন বললেন, তার খুবই জরুরি একটা ফোন আসবে। আরেকজন পুরোপুরি না শোনার ভাব ধরলেন। বুঝতে পারলাম, আর জানানো হবে না। ক্ষোভে-দুঃখে চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ পেছন থেকে একজন কাঁধে হাত রাখলেন।
—ভাইজান কি ফোন করবেন? আমারটা নেন। এখনো ত্রিশ টাকার মতো আছে।
ফোনটা রীতিমতো ছিনিয়ে নিলাম। হাত কাঁপছে। আব্বা-আম্মা দুজনেরই নম্বর ভুলে গেছি। ০১৭ পর্যন্ত চাপ দেওয়ার পর আর মনে করতে পারছি না। তিনি আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন।
—ভাই জিরান একটু। ফ্যালাইটের ম্যালা দেরি। আপনি ফোনটা রাখেন, সমইস্যা নাই।
আম্মার নম্বর মনে পড়লে অবশেষে। রিংয়ের পর ঞ্যালো বলতেই বললাম, আম্মা আমি বের হতে পারব না আর।
—জানি আমরা। তোর আব্বা এইমাত্র একজনকে জিজ্ঞেস করে জানল। মন খারাপ করিস না আব্বা। ভালো মতো পড়াশোনা করিস।
ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তার নাম, কোথায় যাচ্ছেন?
‘আমার নাম রিপন। দুবাই যাইতেসি। ইলেকট্রিশিয়ানের চাকরি পাইসি। ২০ হাজার টেকা ব্যাতন।’ একগাল হেসে বললেন তিনি।
প্লেনে ওঠার আগে রিপন ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, থ্যাঙ্ক ইউ ভাই, আপনি আমার গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল। আপনার কথা কোনো দিন ভুলব না।
গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল মানে তিনি বুঝেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু হেসেই বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। যেখানেই থাকেন না কেন, ভালো থাকবেন রিপন ভাই।

সালমান বিন হোসাইন: গবেষক, ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র।