আমাদের পয়লা বৈশাখ

মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে লেখকের মেয়ে। ছবি লেখক
মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে লেখকের মেয়ে। ছবি লেখক

কুষ্টিয়া ও পাবনাকে বিভক্ত করে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়ে চলেছে প্রমত্তা পদ্মা নদী। তার বুকে প্রতিবছরই চর জেগে ওঠে। পাবনা প্রান্তের চরগুলো বেশ কয়েক শতক ধরে স্থির হয়ে আছে। সেগুলোই বিভিন্ন নাম নিয়েছে। যেমন চর ভবানীপুর, চর ঘোষপুর, চর রঘুনাথপুর ইত্যাদি। চর ভবানীপুরে আমাদের বসবাস। সব মিলিয়ে হাজার তিনেক মানুষ আমরা। সবার জীবিকায় কৃষি নির্ভর। এর বাইরে বিভিন্ন পেশার মধ্যে কয়েক ঘর জেলেও আছেন। হাতেগোনা দু-একজন ছুতোর বা কামারের কাজ করেন। আমাদের খাদ্যাভ্যাস একেবারে সেকেলে। বিদ্যুৎ কী বস্তু তখনো আমরা জানি না। রাতে রান্না করা আউশ ধানের লাল চালের ভাত বেচে গেলে সেটাকে ভাতের পাত্রেই পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় সকালে খাবার জন্য। কারণ খুব ভোরে উঠে পরিবারের পুরুষদের মাঠে চলে যেতে হবে। মাটির সানকি বা ঢুকসাতে করে আমরা সেই পান্তা খেতে পেতাম। সঙ্গে সামান্য লবণ আর কখনো যোগ হতো নিজস্ব খেতের কাঁচামরিচ। আর দিনের বাকি দুইবেলা আলাদাভাবে ভাত রান্না করা হতো। এটাই গ্রাম বাংলার শাশ্বত জীবন প্রণালি।

নাগরদোলায় লেখকের মেয়ে। ছবি লেখক
নাগরদোলায় লেখকের মেয়ে। ছবি লেখক

নদী একসময় তার নিয়ম অনুযায়ী চরগুলোকে গ্রাস করে নিল। কারণ নদীর একুল ভাঙে ওকুল গড়ে। এইতো নদীর খেলা। আমরা আরও একটু পাবনা প্রান্তের দিকে সরে গিয়ে নিজেদের নতুন বসতি তৈরি করলাম। আমার দাদির বুদ্ধিতে শুধু আমার আব্বাকে সপরিবারে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদীতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এখানেও আমাদের মোটামুটি একই রুটিনে খাওয়া দাওয়া চলতে থাকল। সকালে আব্বা পান্তা খেয়ে কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন আর আমরা বেড়িয়ে পড়ি স্কুলের উদ্দেশে। শুধু দুটি জিনিসে পরিবর্তন এল। খেতের আউশ ধানের লাল চালের পরিবর্তে তখন আমরা দোকান থেকে কিনে আনা ইরি ধানের সাদা চালের ভাত খাই। মাটির সানকি আর ঢুকশার জায়গায় এসেছে টিনের প্লেট। সঙ্গে যথারীতি লবণ আর কাচা মরিচ থাকত।

বানরের খেলা শেষে হাত মেলানো। ছবি লেখক
বানরের খেলা শেষে হাত মেলানো। ছবি লেখক

জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একসময় ঢাকা শহরের এসে উপস্থিত হলাম এই আমি। ঢাকা শহর ছিল আমার জন্য স্বপ্নের শহর। কুষ্টিয়া থাকতে শুনতাম ঢাকার বাতাসে টাকা ওড়ে। আমাদের জন্য অবশ্য অতটা সহজ ছিল না জীবনযাত্রা। আমরা টিউশনি করে নিজেদের জীবনের সমুদয় খরচাপাতি করে বাড়তি টাকাটা গ্রামে বা অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ছোট ভাইকে পাঠাতাম। আমার হলজীবনের বাইরে আলাদাভাবে টাকা খরচ করে আনন্দ করার সংগতি ছিল না। তাই আমি চেষ্টাও করতাম না। কিন্তু অনেককেই দেখতাম নিজেদের চাষা উপাধি মুছে ফেলার জন্য হলেও চাকচিক্যময় ভদ্রলোকসুলভ জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দিতে।
পয়লা বৈশাখ এলেই কিছু মানুষ সকালবেলায় পাঞ্জাবি পরে বেড়িয়ে পড়তেন। আমরা হয়তো তখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠেছি। তাই তাদের দেখে ফেলতাম। প্রাকৃতিক কর্ম সেরে আমরা আবার ঘুম দিতাম। তখনই প্রথম জানতে পারলাম পয়লা বৈশাখে ঢাকা শহরের মানুষ উৎসব করে সানকিতে করে পান্তা খায়। সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজি এবং হরেকরকমের ভর্তাতো থাকেই। এটা শুনে আমার একই সঙ্গে ভালো লাগা ও খারাপ লাগার একটা অনুভূতি তৈরি হলো। ভালো লাগল এই কারণে, বাঙালি তার শেকড়কে ভুলে যায়নি। আর খারাপ লাগল, এরা শুধুমাত্র একদিনের বাঙালি সাজার জন্য গরিবের পান্তা খায় কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলো তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তাই আমি কোনোভাবেই সেই উৎসবগুলোকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারিনি। সেই একই কারণে যোগদানও করতে যাইনি।

বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম। ছবি লেখক
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম। ছবি লেখক

পড়াশোনা শেষে চাকরিও হলো ঢাকা শহরের এক বহুজাতিক কোম্পানিতে। তারপর বিয়ে বাচ্চাকাচ্চা সময়ের হাত ধরেই এল। তখন সত্যিকার অর্থে পয়লা বৈশাখ পালনের জন্য তাগাদা অনুভব করলাম। কারণ অন্ততপক্ষে নতুন প্রজন্মকে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের যাওয়া উচিত। তাই গিন্নির সঙ্গে আলাপ করে আগের দিন থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম। আর পয়লা বৈশাখের পোশাক আগে থেকেই কিনে আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হতো। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পেটভরে পান্তাভাত খেয়ে আমরা দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। সোনারগাঁও হোটেলের সিগন্যালে সব পরিবহনকে থামিয়ে দিলে আমরা হাঁটা শুরু করতাম রমনার উদ্দেশে। বাকিরা সবাই হেঁটে। শুধু আমার দুই বছরের মেয়ে তাহিয়া ছোট বলে তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিতাম। ছায়ানটের গানগুলো শোনার পর আমরা হাঁটা শুরু করতাম চারুকলার দিকে। রমনা পার্কের চারুকলার অনুষ্ঠানে তত দিনে অনেক পরিবর্তন এসেছে বোমা হামলা হওয়ার পর থেকে। চারদিকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী সোয়াটের সদস্যরা বটমূলটাকে ঘিরে রেখেছে। আমার কাছে সর্বজনীন পয়লা বৈশাখকে অনেকটা শৃঙ্খলিত মনে হতো। একবারের অনুষ্ঠান শেষে ছায়ানটের সানজিদা খাতুন সেই কথাগুলোই বললেন।
চারুকলায় গিয়ে আমাদের আনন্দের সীমা থাকত না। সেখানে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। শিল্পীরা তাদের সৃষ্টিগুলোতে শেষ মুহূর্তের আঁচড় দিতে ব্যস্ত। একটু পরেই এগুলোকে রাস্তায় বের করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হবে। আমরা ছুটোছুটি করে সবগুলো কাজ দেখে নিতে চেষ্টা করতাম আগে থেকেই। তারপর মঙ্গল শোভাযাত্রার পেছনে পেছনে হাঁটা। মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষ হলে আবার চারুকলার ভেতরে ফিরে নাগরদোলায় চড়তাম। তাহিয়ার বয়স তখন সবে দুই বছর। কিন্তু তবুও সে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিত নাগরদোলায় চড়ার জন্য। অগত্যা তাহিয়া আর তার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় খালা তান্নাকে নাগরদোলায় চড়িয়ে নিস্তার পাওয়া যেত। এ ছাড়া আমরা আরও অনেকভাবে আনন্দ করতাম। তার মধ্যে ঘোড়ায় চড়া ছিল অন্যতম। আর হাতভর্তি কাচের চুড়ি কেনা ছিল তাহিয়ার কাছে অনেক আনন্দের। এভাবে একসময় আমরা হাঁটতে হাঁটতে আমার প্রাণের স্পন্দন যেখানে সেই বুয়েটে এসে হাজির হতাম।
বুয়েটের প্রত্যেকটা দেয়াল, ইট থেকে শুরু করে ঘাস গাছের পাতা আমার খুবই আপনজন। তাই পয়লা বৈশাখে অন্ততপক্ষে একবারের জন্য হলেও প্রিয় ক্যাম্পাসে ঢুঁ মারতাম আমরা। বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের কারুকাজ আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। সামান্য একটু জায়গার মধ্যে তারা পরিপাটি করে তাদের কাজগুলো প্রদর্শন করত। আর সঙ্গে থাকতে আরও অনেক আনন্দের উপকরণ যেমন বানর খেলা। একবার আমরা গিয়ে সৌভাগ্যবশত বানরের দেখা পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাহিয়াকে একটা ভেলকি দেখিয়ে দিলাম। বানরওয়ালা বানরকে যা বলছে সে সঙ্গে সঙ্গে সেটা করে দেখাচ্ছে। এটা দেখে তাহিয়া অনেক বেশি মুগ্ধ হলো আর আমাকে প্রশ্ন করে চলল বানর কীভাবে মানুষের কথা বোঝে, সে কীভাবে মানুষের কাজগুলো করে ইত্যাদি। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেলাম ওর ঔৎসুক্য মেটাতে। খেলা দেখানো শেষ হলে বললাম তুমি বানরের সঙ্গে হাত মেলাও। শুরুতে একটু ভয় পেলেও পরে ওর খালা তান্নার উৎসাহে সে বানরের সঙ্গে হাত মেলাল।

সিডনির পয়লা বৈশাখ। ছবি লেখক
সিডনির পয়লা বৈশাখ। ছবি লেখক

পয়লা বৈশাখের অনেকগুলো আনন্দের মধ্যে গালে বাহারি রঙের শুভ নববর্ষ লিখে নেওয়া ছিল তাহিয়ার অন্যতম পছন্দের কাজ। তাই প্রায় প্রতিবারই আমরা বাস থেকে নেমে হাঁটার শুরুতেই প্রথমেই যে আঁকিয়েকে আগে পেতাম তার কাছ থেকে গালের মধ্যে আঁকিয়ে নিতাম। তা ছাড়াও সস্তার ডুগডুগি থেকে শুরু করে টমটম গাড়ি সবই আমরা কিনে নিয়ে তবেই বাসায় ফিরতাম। ফুটপাতের বেলুনওয়ালার কাছ থেকে বেলুন কিনে সেটা হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরে রাখত তাহিয়া যাতে তার বেলুনটা সবচেয়ে বড় মনে হয়। একসময় এসে আমরা শাহবাগের ফুলের দোকানগুলো থেকে ফুলের টোপর কিনতাম। তারপর সেটা পরে সারা দিন ঘুরে বেড়ানো ছিল আমাদের আরও একটি আনন্দের অনুষঙ্গ।
আমাদের প্রবাস জীবনের তিন বছর ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আমরা বাংলাদেশের আদলে পয়লা বৈশাখ পালন করতে পারিনি। অবশ্য এখানে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন থাকে বাঙালিয়ানাকে ধারণ করে। বিভিন্ন কারণে আমরা এখনো কোনো মেলাতে যেতে পারিনি। তকে পয়লা বৈশাখের আগের রাতে মানে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে আমরা যেকোনো আকারের একটা ইলিশ মাছ বাংলা দোকান থেকে কিনে আনতাম। আর সেটাই অনেক যত্ন করে রেঁধে রেখে দেওয়া হতো পরদিন পান্তার সঙ্গে খাওয়ার জন্য। আর ভাত রান্না করে সেটাতে পানি দিয়ে রাখা হতো একই সঙ্গে। পরদিন খুব ভোরে উঠে সবাই মিলে হাপুসহুপুস করে সেই পান্তা আর ইলিশ খেয়ে যারযার কর্মব্যস্ত দিন শুরু হতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে সেখানেও থাকত বৈশাখের স্পর্শ। তবে সেখানে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতাও দেখেছি। কে কার চেয়ে কত বেশি পদের রান্না বা ভর্তা করতে পেরেছেন সেটা নিয়ে দেখতাম কথা বলতে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে শুধু নিজেরাই অনাড়ম্বরভাবে পালন করব পয়লা বৈশাখ।

টমটম গাড়ি হাতে ছোট্ট রায়ান। ছবি লেখক
টমটম গাড়ি হাতে ছোট্ট রায়ান। ছবি লেখক

তবে এবারের পয়লা বৈশাখ নিয়ে আমরা একটা সুন্দর পরিকল্পনা করেছিলাম। কারণ এবার পয়লা বৈশাখের দিনটা ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার। আমরা আর তাহিয়ার বান্ধবী জেইনারা মিলে পালন করেছি এবারের পয়লা বৈশাখ। আমরা কী কী করব তার একটা তালিকাও করেছিলাম। এখানকার চেইনশপ কেমার্টে বাংলাদেশের টমটম গাড়ির মতো একটা খেলনা পাওয়া যায় যেটার মাথায় সুতলি লাগানো থাকে। এই সুতলি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। আমরা ছোট্ট রয়ানের জন্য একটা কিনে ফেলি। পয়লা বৈশাখের আগের দিন জেইনার ছোটবোন জাহিয়ার জন্য আরও একটা কিনেছি। আরও একটা খেলনা পাওয়া যায় একটা দণ্ডের মাথায় মৌমাছি বা এমনি আরও কোনো ছোট প্রাণী। যেটা বাংলাদের লাঠির মাথায় লাগানো হেলিকপ্টারের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা মাটিতে ঠেলে চালানোর সময় হেলিকপ্টারের পাখাগুলো ঘুরে। সেটাও কেনা হয় জাহিয়া ও রায়ানের জন্য। এ ছাড়া আমরা বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলে ছোটদের জন্য তৈরি করি মুখোশ।
খাবার হিসেবে ছিল পান্তা ভাত আর ইলিশের ভাজি। সঙ্গে ভর্তা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কার পার্কিঙের লনে মাদুর বিছিয়ে আমরা বসে যাই। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পান্তা ইলিশ দিয়ে নাশতা সেরে যার যার দিনের কাজ শুরু করি। ইউটিউবে আমরা ছেড়ে দিই বৈশাখের সর্বজনীন সেই গান—‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপ নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। আর ছোটরা খেলে তাদের খেলনা দিয়ে। এভাবেই আমাদের বাসায় তৈরি হয় ছোট একখণ্ড রমনার বটমূল অথবা চারুকলার বকুলতলার আবহ।
আমরা প্রবাসে পাড়ি দেওয়া প্রথম প্রজন্ম। তাই এখনো সবকিছুকেই বাংলাদেশের মতো করে পালন করার চেষ্টা করি আর সেই সঙ্গে চেষ্টা থাকে পরবর্তী প্রজন্মকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার। জানি না ওরা এর কতটা নিতে পারছে। একমাত্র ভবিষ্যৎই পারবে এর সঠিক উত্তর দিতে। আমরা আপাতত সেই উত্তরের অপেক্ষা না করে আমাদের পয়লা বৈশাখ পালনের আমেজ নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।