মা এখন দূর আকাশের নক্ষত্র

লেখিকা
লেখিকা

আমার মাকে যখনই ফোন করতাম মা রিসিভ করতেন। অবাক হয়ে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা সেলফোন কি সারাক্ষণ সাথে রাখ?

উত্তরে মা বললেন, হ্যাঁ। তুই কখন ফোন করস, না পেলে তো আবার চিন্তা করবি, আম্মা কই! আম্মা ভালো আছে তো?
আমার যাতে ভাবতে না হয়, আমি যেন চিন্তায় পড়ে না যাই, সে খেয়ালও রাখতেন এই বয়সে এসে। মায়েদের কাছে সন্তানেরা বুঝি এমনি হয়।
প্রবাসজীবনে এসে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি আপনজনদের। বিশেষ করে মাকে। অবশ্য স্কুল জীবন শেষে যেদিন কলেজে ভর্তি হলাম, বাবা-মায়ের আঁচল ছেড়ে বাইরের জগতে পা রাখলাম, সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম বাবা-মা কত আপন। আর প্রবাসজীবনে এসে প্রতি পদক্ষেপে অনুভব করেছি।
এখনো খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠি। এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। আমার মা এই অভ্যাস গড়ে দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড রকম ধার্মিক ছিলেন আমার মা। ফজরের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়তেন ঘুম থেকে আর আমাদের ডেকে তুলতেন এই উঠ, আর কত ঘুমাবি! নামাজ কালাম নাই, যত্তসব।
বিরক্ত হয়ে বলতাম আরেকটু ঘুমাই, এই তো উঠে যাব।
রাজ্যের ক্ষোভ নিয়ে বলতেন, আরে আমি মরলে বুঝবি তখন ডাকারও কেউ থাকবে না।
আজ পাঁচ দিন হলো আমার মা মারা গেছেন।
কানে বাজছে সেই কথাগুলো। সেই শৈশব, কৈশোর স্কুল জীবনেই শুধু বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা। তারপর ইন্টারমিডিয়েট বড় ভাইয়ের বাসায়। অনার্স ও মাস্টার্স মেজ বোনের বাসায়। তারপর বিয়ে ও আমেরিকা আসা। হিসাব করে দেখলাম স্কুল জীবন পর্যন্ত শুধু বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা। তারপর তাঁদের সঙ্গে থেকেছি যেমন ঈদের সময়, রমজানে কিংবা কলেজ বন্ধ পড়লে। কিন্তু শৈশব-কৈশোরের মতো করে একসঙ্গে আর থাকা হয়নি। আজ পেছন ফিরে দেখি সুখের স্মৃতিগুলো ওই স্কুল জীবনেই।
ওই সময় আমার প্রচুর ঘন চুল ছিল। এর পুরো কৃতিত্ব ছিল আমার মায়ের। চুল আমার আর যত্ন নিতেন আমার মা। চুল আঁচড়ানো, দুই বেণি করা। ফিতা দিয়ে ঝুঁটি করে দেওয়া, কিংবা ঘুমিয়ে গেলে কখন যে মাথায় (নারকেল থেকে কীভাবে যেন তেল তুলতেন) তেল দিয়ে দিতেন। আমি বুঝতাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠলে দেখতাম সারা মাথায় তেল। খুব রাগ করতাম। চুল এত বড় হতে লাগল ও সিল্কি। স্কুলের বান্ধবীরা আমাকে ডাকতে লাগল কেশবতি কন্যা।
সেই আমি যখন কলেজে ভর্তি হলাম বড় ভাইয়ের বাসায় এলাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য কেউ আর ডাকে না। চুল এলোমেলো হয়ে মাথা পুরা কাকের বাসা। কেউ আর আঁচড়ে দেয় না। কেউ আর খাবার নিয়ে বসে থাকে না।
কেউ আমাকে শাসন করে বলে না, নামাজ রোজা কর, লেখাপড়া কর। মায়ের ছায়া থেকে বের হয়ে বুঝে গিয়েছিলাম মা কতটা আপন। আমি যেন ইউ টার্ন নিচ্ছিলাম পেছনের দিকে। যত ওপরে ক্লাসে যাচ্ছি, দুনিয়া দেখছি তত মা আমার প্রিয় থেকে প্রিয় হয়ে উঠছিলেন।
যখন অনার্সে ভর্তি হলাম (কুমিল্লায়) ভাবলাম হলে থাকব। মেজ আপা বললেন, আমার বাসায় চলে আয়, হলে যাবি কেন? শেষ পর্যন্ত আপার বাসায় থাকা। দীর্ঘ একটা সময়। আমার বিয়েও হয় এই আপার বাসায়।
বড় ভাইয়ের বাসায় ও আপার বাসায় থাকা অবস্থায় আমার মা একটা কাজ করতেন। বাড়িতে পুকুরে বড়জাল ফেলে প্রচুর মাছ ধরে ভাইয়ের বাসায়, আপার বাসায় পাঠাতেন আমার জন্য। বলতেন বেলি (বেলি আমার ডাক নাম) তো মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না।
এই নিয়ে বড় ভাইয়া, আপা কত হেসেছেন। বলতেন আমরা কি গরিব? বেলিকে খেতে দিই না? আর আমরা কি তোমার সন্তান না? কই আমাদের বেলায় তো এত আদর দেখি না। আম্মা শুনে হাসতেন। বলতেন, ও সবার ছোট তোরা তো আরও বেশি আদর করস। আমরা তিন বোন, দুই ভাই, আমি সবার ছোট।
শুধু মাছ কেন, আমার যা পছন্দ আম্মা সবকিছুই পাঠাতেন। আপা হাসতেন আর বলতেন যাক তোর অছিলায় আমরাও একটু খাই। এমনকি বিয়ের পর আমার শ্বশুর বাড়িতেও পাঠাতেন।
ছোট সন্তান বলে হয়তো আমার প্রতি একটু বেশি টান ছিল।
আমেরিকা আসার পর ফোনে যতবার কথা হতো জিজ্ঞেস করতেন, দেশি খাবার পাই তো? মাছ পাওয়া যায় তো? বলতাম নিউইয়র্ক থেকে বাজার করে নিয়ে আসি দুই মাস পরপর। ফ্রিজে রেখে খাই। শুনে বলতেন আহারে এইগুলো কী আর স্বাদ লাগে!
এমনভাবে বলতেন যেন আমি সেই ছোট রয়ে গেছি।
আমেরিকা আসার পর যতবার বাংলাদেশে গিয়েছি জেএফকে বিমানবন্দর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত এই সময়টুকু আমার মা নামাজেই থাকতেন যেন আমি নিরাপদে পৌঁছাতে পারি। মায়েরা বুঝি এমনি হন।
মায়েদের ভালোবাসার ভান্ডার অফুরন্ত। অথচ, সংসারে যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত তিনি হলেন মা। তাঁর কথার গুরুত্ব কেউ দেয় না। না সন্তান, না স্বামী। সকাল থেকে রাতের মশারি টানানো পর্যন্ত যে মানুষ পরিশ্রম করে সে হলো মা। এত এত পরিশ্রম শুধু সংসারের মানুষগুলো ভালো থাকুক এই তার নিঃস্বার্থ চাওয়া। অথচ আমরা সন্তানেরা শুধু অভিযোগ আর অভিমানই করি। মায়ের দিকে ফিরে তাকানোর সময় আমাদের নেই। আমরা বুঝি তবে হারানোর পর।
আমার মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৬ সালের জুলাইতে। কে জানত এটাই শেষ দেখা। আসার সময় হাতের এক জোড়া বালা (সোনার তৈরি) দিয়ে বলেছিলেন, এটা রেখে দে তোর মেয়েকে দিস। আমিই অনার্সে পড়ার সময় বানিয়ে দিয়েছিলাম আমার গলার চেইন ভেঙে। খুব অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম এই বালার কথা।
আসলে মায়েদের সব মনে থাকে। আমিও একজন মা। আমারও একটি মেয়ে আছে। ভেবে দেখলাম, না আমি আমার মায়ের মতো করে আমার মেয়ের এত যত্ন করি না।
মা তুমি ভালো থাকো ওপারে। হাজারো তারার ভিড়ে এখন তোমায় খুঁজি।

(১২ এপ্রিল ২০১৮)

এম আর ফারজানা: নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র।