ম্যাশ, মুশফিক, সাকিব - ওদের দেশের আমি

আমি ক্রিকেটপ্রেমী নই। আগ্রহ নেই, তাই তেমন বুঝি-টুঝি না। আমার বর শাখাওয়াত একদমই উল্টো; ক্রিকেটে ওঁর যত প্রেম, অতটা আমাকে দিলে হয়তো এ যুগের লাইলি হতে পারতাম!

যখনই বাংলাদেশ টিম খেলে শাখাওয়াত রাত জাগে। সোফায় ঘুমায়। কিছুক্ষণ পরপর ডাকাডাকি করে এটা-ওটা দেওয়ার জন্য। ফুটফরমায়েশ করায়—আমার ভীষণ ইজ্জতে লাগে; নিজেকে পিচ্চি অনুভব হয়। নিজের প্রতি গুরুত্বহীনতা ভেবে হৃৎপিণ্ডের টিকটিক খানিকটা হলেও শ্লথ হয়ে যাওয়ার দশা হয়! এসব নিয়ে খুঁটখাঁট লেগেই থাকে। কখনো তাই গৃহদাহ কমাতে টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে ঘুমের ভান করে, কিন্তু ঘুমায় না! বিরতি দিয়ে হাতের কাছে রাখা ফোনে দেখে নেয় খেলার আপডেট। হারজিৎ দুটো ভেবেই ওঁর সে কি উত্তেজনা! এমনও হয়েছে বাংলাদেশ টিম জিতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে চিৎকার করছে। আমার ও বাচ্চাদের তখন ঘুমের বারোগতি!

ঠিক সেসব কারণেই কিনা ক্রিকেটে আমার ভাললাগা থাকলেও, ভালোবাসাটা অত ছিল না। ভাসা-ভাসা। জলের ওপর ওড়াউড়ি, জল স্পর্শ করা নয়।

বছর দু-এক আগ থেকে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কারণ, আমার বাপজান দীপ্র বাংলাদেশের জয় ও টাইগার্স টিম ব্যাপার-স্যাপার বুঝে গিয়েছে। যেদিন বাংলাদেশ জিতে, সেদিন দীপ্রর ভাবসাব, মেজাজ-মর্জি বেশ ফুরফুরে থাকে। পরদিন স্কুলে গিয়ে গল্পো দেয়, জয়ের দিন স্কুলে চকলেট বিলোয় বন্ধুদের। এসব দেখে আমিও বদলে গিয়েছি।

ক্রিকেট-মঙ্গল প্রদীপের আলোকশিখা আমাকেও ছুঁয়েছে। আজকাল কোথাও যদি অন্য দেশীরা প্রশ্ন করে তুমি কি ভারতীয়? আমার গর্ব করে বলি,
: না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ম্যাশ, মুশফিক, সাকিব, তামিম ওদের দেশের আমি।

এখানে বাঙালি পাড়ার রেস্টুরেন্টগুলোও বাংলাদেশের খেলার দিন অন্য আমেজে সাজে। কাজ শেষে খাবার খেতে খেতে বন্ধুরা মিলে খেলা দেখে। আডডা দেয়। কেউ কেউ তো পার্টিও ডেকে বসে ‘জয়’ এর দিন।

বাংলাদেশের যে কোনো উৎসব পার্বণ আয়োজনেও প্রবাসীদের যে কি দরদ তা অকল্পনীয়। মনোহরিয়া। কমিউনিটি আয়োজিত উৎসবগুলোতে আমার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার কারণেও দেখতে পাই দেশের প্রতি বাংলাদেশিদের টান-প্রেম কতটা গাঢ়! অদ্ভুত বৈচিত্র্যে ভরা সেসব গল্প। সদ্য আয়োজিত বৈশাখ উদ্‌যাপনেও সে প্রমাণ মেলে। পূর্ব প্রস্তুতিকালে দেখেছি আড্ডায় একে অপরকে বলছে—দোস্ত, এমনে সাজাব যেন শ্বেতাঙ্গরা টের পায় বাঙালি কি!

শুনেছেন কখনো—রাজপথ আটকে দিয়ে বিদেশে বাঙালিরা অনুষ্ঠান করে? প্রতিবাদ করে? সহযাত্রী হয়ে সাহস জোগায়?

সিডনিতে অমনটা প্রায়ই হয়। এটাই চিরাচরিত বাঙালি প্রেম। দেশপ্রেম।

সে প্রেমে পাল তুলেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। এর অন্য রকম একটি দৃষ্টান্ত দেই আপনাদের; সে দৃশ্যে আমার চোখ জল ছুঁয়েছে।

আমার ছেলের বন্ধু নিশো। ওরা পাশের পাড়ায় থাকে। অস্ট্রেলিয়ায় এখন স্কুল ছুটি। নিশোর আমন্ত্রণে দীপ্রকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাওয়া। প্রবেশদ্বারে থাকা একটি ‘বাঘ’ এর প্রতিকৃতি নজর কাড়ল। নিশোর বাবা পারভেজ ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন নেপথ্য কাহিনি।

তাঁদের বাড়ির ঠিক সামনের বাড়িটি ভারতীয়দের। পাশের বাড়িটি পাকিস্তানিদের এবং প্রতিবেশী বাড়িটি শ্রীলঙ্কানদের। তারা ময়ূর, সিংহ দিয়ে প্রবেশদ্বার সাজিয়েছেন। বাড়ির বাইরে আসা-যাওয়ার পথে এসব দেখতে পারভেজ ভাইয়ের চোখ জ্বলে। মন পোড়ায়। তাই অনেক খুঁজে পেয়েছেন এই ইট-সুরকির বাঘ!

মনে মনে বলি—কী সর্বনাশ! দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। বাংলাদেশিদের সমস্যা একটাই, সারাক্ষণ মুখে—বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।

কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের দুই বাসের রেষারেষিতে নিহত রাজীবকে ভীষণ মনে পড়ছে। প্রিয় রাজীব, আমাদের দেশপ্রেমে অমন চপেটাঘাত না করলেই কি হতো না? কেন চলে গেলেন!