জেনেভায় বাঙালি ও সুইসের যৌথ বর্ষবরণ
বিশ্বায়নের এই যুগে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তাই বলে আবহমানকাল ধরে চলে আসা উৎসবমুখর বাঙালির প্রাণের বৈশাখ বরণের দৃশ্যপটের তারতম্য ঘটেনি কোথাও। বৈশাখ মানে যে শুধু নতুন বছরকে সাদরে বরণ করা, তা নয়। আমার মনে হয় সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর এক অপূর্ব মহামিলন উৎসবও বটে।
গত শনিবার (১ বৈশাখ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ) জেনেভা বাংলা পাঠশালা ও সুইস বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো আলপনা আঁকা, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও এক মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছর যাবৎ জেনেভা বাংলা পাঠশালা দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রতিটা আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছিল।
বিগত দিনগুলোর অনুষ্ঠানগুলোকে সুইজারল্যান্ড সরকারের অধীনে সাংস্কৃতিক বিভাগ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে এবারই প্রথমবারের মতো সুইস বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে; যা কিনা জেনেভায় বসবাসরত সমগ্র বাঙালির জন্য ছিল পরম সৌভাগ্যের বিষয়। জেনেভা শহরের মূলকেন্দ্রে অবস্থিত স্থানীয় একটি প্রসিদ্ধ এলাকা ফরাসি ভাষায় যা ‘পাকি’ নামে পরিচিত।
এই ‘মেইজন দ্য কেইতিয়ে দ্য পাকি’ অ্যাসোসিয়েশনের পাঁচবারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত যুবক আরিনুল হকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ফরাসি ভাষাভাষী সুইসদের যৌথ প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়।
বাংলা পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রিয়াজুল হকের পরিচালনায় পাঠশালার শিক্ষার্থীরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গানসহ বিভিন্ন ধরনের সংগীত ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশকেই যেন তুলে ধরা হয়। দর্শক সারিতে ছিলেন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের ভাষার মানুষজন। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে তবলায় ছিলেন ইংল্যান্ড থেকে আগত বিখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ ইউসুফ আলী খান। তাঁর জাদুকরি তবলার সুরের মূর্ছনায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা ছিলেন বিমোহিত।
নাচের কোরিওগ্রাফি ও বেহালায় ছিলেন ফারানা হক। যার কথা আমি বিশেষভাবে বলতে চাচ্ছি। আরও বলতে চাচ্ছি, নাসরিন হক, আরিনুল হক ও স্বর্ণা হকের কথা। যাদের অবদানে প্রতি বছর জেনেভায় কিছু সার্থক অনুষ্ঠান আমরা দেখতে পাই। সে পথ পরিক্রমায় সুইস বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের সকল কার্যকরী সদস্য ও তাদের পরিবার পরিজনদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বছরের শুরুতে আমরা এমন সুন্দর অনুষ্ঠান উপহার পাই।
পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে ফরাসি ও বাংলা ভাষায় সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন এ্যানি (সুইস) ও তান রহমান। আর অতিথি আপ্যায়নে ছিল দেশীয় খাবারের ব্যবস্থা। খাবার পরিবেশনের পর সুইসদের মাঝে আমাদের পান সুপুরি নিয়ে দেখা যায় ব্যাপক আগ্রহ। তার বর্ণনা অবশ্য দিতে হয়েছে আমাকে বেশ কয়েকবার।
জেনেভায় এবারকার বর্ষবরণ ঘিরে যে আলপনা ও মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সুইস ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে আদান প্রদান হয়েছে তাতে আমি বলব আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বেশি লাভবান হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন মত, ধর্ম ও রাজনৈতিক মানুষের যে মেলবন্ধন দেখা গেছে তা সত্যই ছিল অনুকরণীয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যকর্ম প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাঙালি জাতি শুধু বাংলা ভাষার জন্যই বাঙালি নয়, বাংলা কৃষ্টি, কালচার দিয়ে যে অপরের চিত্তলোকে গমন করতে পারে, সে জন্যই বাঙালি।’
আমার ওপরের লেখার মূল বিষয় যেন বিশ্বকবির এই দুই লাইনের মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে।
কালো, অন্ধকার, সংকীর্ণ মন মানসিকতার মুখ ও মুখোশগুলো বিসর্জন দিয়ে, পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে, আমরাও পারি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এক বাংলার প্রাণ হয়ে গৌরবে দেশের মান ধরে রাখতে।
শুভ নববর্ষ ১৪২৫।
রাওদাতুল জান্নাত: জেনেভা, সুইজারল্যান্ড।