ঋণ শোধের আকুলতা আমায় তাড়া করে ফেরে

হিউস্টনের ডাউন টাউন
হিউস্টনের ডাউন টাউন

অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সটা খুব ছিমছাম। ছবির মতোই সাজানো। দেখে মনে হয় যেন ভিউকার্ড দেখছি। নামটাও দারুণ! ‘স্টোন ক্রসিং’! নামটা শুনে মনে হয় যেন ছোট ছোট পাথরে পা ফেলে ফেলে খাল পেরোব। চারদিকে পাইন, ম্যাপল ও আরও অনেক নাম না জানা গাছের সারি। সারা শহরেই বৃক্ষরাজির অভাব নেই। তাই বোধ হয় শহরের নাম ‘গ্রিনসবোরো’ নামটা অনেকটা ঢাকার সবুজবাগের সঙ্গে মিল আছে। শহরটার অবস্থান নর্থ ক্যারোলিনায় মারজরি রলিংয়ের বিশ্বখ্যাত ছোটগল্প এ মাদার ইন মেনভিলের নর্থ ক্যারোলিনা। পাহাড় আর নদীর ভালোবাসার গল্পের নর্থ ক্যারোলিনা। ধোঁয়া ধোঁয়া পর্বতের দেশ (স্মকি মাউন্টেন) নর্থ ক্যারোলিনা। কিন্তু সমস্যা একটাই। ভিউকার্ডের এই নীরব শহরে যে আমার মন বসে না। এই শহর অনেক ‘নেই’-এর সমাহার যেন দিন যায় আর নেই-এর তালিকা বড় হতে থাকে কেবল।

হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টার
হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টার

—নেই ফেরিওয়ালার হাঁকাহাঁকি।
—নেই রিকশার টিং টিং বেল বাজানোর শব্দ।
—নেই কোনো মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আজান।
—নেই কোনো কাপড় মেলা বারান্দায়।
—নেই কোনো ভিখারির ‘আমার আল্লা রাসুলুল্লাহ’-এর সুর।
—নেই কোনো পলেস্তারা খসে যাওয়া দালান।
—নেই কোনো ট্র্যাফিক জ্যাম।
—নেই কোনো কারণে অকারণে হর্ন বাজানো।
—নেই কোনো বাজার সদাইয়ের দরদামের হাঁকাহাঁকি।
—নেই কোনো হঠাৎ আকাশের কোণে সেজে আসা কালো মেঘমালা।
—নেই হঠাৎ ঝুম করে নামা তুমুল ‘বরিষন ধারা’।
—নেই আমার মায়ের মাড় দেওয়া শাড়ির ঘ্রাণ।
—নেই আমার বাবার অহেতুক বকাঝকি।
—নেই হঠাৎ করে বাসায় চলে আসা মেহমানের ঝক্কি।
—নেই রোজার মাসের ইফতারির টেবিল ঘিরে আমাদের পুরো পরিবার।
—নেই রাস্তার দুই পাশে হঠাৎ করে জেগে ওঠা ইফতারির প্যান্ডেল।
—নেই সাহরির মেলা আয়োজন।
—নেই ঈদের আলোকসজ্জা।
—নেই শবে বরাতের রুটি আর বুটের হালুয়া।
—নেই পয়লা বৈশাখের রমনার বটমূলে বৈশাখী আয়োজন।
—নেই উদ্দাম কালবোশেখির উত্তাল হাওয়া।
এত সব নেই-এর ভিড়ে হাতড়ে বেড়াই দেশের গন্ধ, দেশের স্পর্শ। হাতড়ে বেড়াই আমার মায়ের ‘সোনার নোলক’। এখানের পানিতে কোনো স্বাদ পাই না। স্বাদ পাই না বেশির ভাগ খাবারেই। মটরশুঁটি আমার ভীষণ প্রিয়। দেশে শুধু শীতকালেই পাওয়া যায় বলে আমার আক্ষেপ ছিল। এখানে শুনি সারা বছরেই মটরশুঁটি বাজারে থাকে। আমি তো মহাখুশি তাই শুনে। ওমা! মুখে দিয়ে দেখি এ নামে মাত্রই মটরশুঁটি। কাঁচা আম খেতে খুব ইচ্ছে হলো। আমার স্বামী চাইনিজ দোকান থেকে বহু খোঁজাখুঁজি করে আমার জন্য কাঁচা আম জোগাড় করে নিয়ে আসেন আমি কাঁচা আমের ডাল খেতে চেয়েছি বলে। বহুদিন পর আমি কাঁচামরিচ, আম ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে আয়েশ করে ভাত খেয়েছিলাম মনে আছে।

উত্তর ক্যারোলিনায় পর্বতমালা
উত্তর ক্যারোলিনায় পর্বতমালা

মনে আছে, শুক্রবার বিকেল বেলাটায় কেমন খাঁ-খাঁ করত মনটা। অনিন্দ্য, অবন্তি, পূর্বা, আদিত্য, অনিলা, অমিয়, অন্তরা—আমার সব ছোট ছোট ভাগনে ভাগনিদের দেখার জন্য মনটা কেবল আঁকুপাঁকু করত। দেশে সব ভাইবোনে মিলে খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা। অনেকটা যৌথ পরিবারের মতোই। এত আনন্দ, এত কোলাহল ভঙ্গ করে সাত সমুদ্দুর আর তেরো নদীর পাড়ে এই নির্জন শহরে কীভাবে দিন কাটবে আমার তাই ভেবে আকুল হতো মন।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড। ১৪ বছর...।
টেক্সাসের হিউস্টন শহরে আস্তানা গেড়েছি প্রায় বারো বছর! এই শহরেই আমার স্বামীর প্রথম চাকরি। আমার ছেলের জন্ম এই শহরে। আমার মেয়ে আর ছেলের বেড়ে ওঠা এই শহরকে ঘিরেই। এখানেই আমার প্রথম বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা। অনেক প্রথমের শুরু এই শহরে। কবে, কোন সময়ে যেন চুপিচুপি ভালোবেসে ফেলেছি এখানের আকাশ, বাতাস, এখানের বৃক্ষরাজি! পরম করুণাময়ের অশেষ ভালোবাসায় আপন করে পেয়েছি বাঙালি, অবাঙালি কত বন্ধুকে। তাই যখন ‘গ্রেভিতি’ মুভিতে সান্দ্রা বুলক বা ‘মার্স’ মুভিতে ম্যাট ডেমন মহাশূন্য থেকে বলে ওঠে, ‘হিউস্টন, ক্যান ইউ হিয়ার মি?’ হঠাৎ করেই মনের মধ্যে তির তিরিয়ে আনন্দ জাগে আমার শহরের নাম শুনে। নিজেই অবাক হই কখন আপন মনে ভালোবেসে ফেলেছি এই শহরকে। অনেকটা সময় পার করে বুঝেছি আরেক জায়গায় শিকড় গাড়তে সময় লাগে। তবে ভালোবাসা পেলে নতুন মাটিতে আস্তে আস্তে শিকড় মেলতে শুরু করে। তারপর আঁকড়ে ধরে থিতু হয় নতুন ডাঙায়। তাই বলে আমার পুরোনো শিকড়কে ভুলে যাইনি কিন্তু। এখনো মাতৃভূমির জন্য মন কাঁদে। খুব ইচ্ছে হয় কিছু করতে। বিধাতা যে দেশ, যে মাটি থেকে আমায় কত কিছু দিয়েছেন উজাড় করে। সেই ঋণ শোধের এক আকুলতা আমায় তাড়া করে ফেরে। আমার প্রিয় জন্মভূমি, তোমারই তুলনা তুমি!

ফারজানা নুর বিন্দু: হিউস্টন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।