সয়াসসের ঘ্রাণে ভরপুর এক চাইনিজ সন্ধ্যা

লেখিকা
লেখিকা

গত বুধবারের কথা। মিউনিখ শহর সেদিন লন্ডন হয়ে গেছে। সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। আকাশে সূর্যের ‘স’-ও নেই। সব মিলিয়ে কেমন একটা বিষণ্ন পরিবেশ। কিছু কাজ জমে আছে। যেগুলো ওই দিন শেষ না করলেই নয়। তারপরও কেন যেন ইচ্ছা করছে না। মেঘলা দিনের অলসতা আমাকে কবজা করে ফেলেছে। এই কবজায় আটকা পড়ে আমার যে খুব খারাপ লাগছে, তা নয়। কিন্তু অস্থির লাগছে। অস্থিরতা বিড়ালের বাচ্চা নয় যে, কোলে নিয়ে পুষতে হবে। এটাকে তাড়াতে হবে। এক কাপ মিন্ট চা বানালাম খুব আয়োজন করে। চায়ের সঙ্গে টা হিসেবে বাদামের কোটা। যেনতেন বাদাম নয়। বাদামের গায়ে ওয়াসাবির কোটিং। ওয়াসাবি হলো জাপানিজ হর্সর‍্যাডিশ। চরম ঝাল। এই ঝালের কোনো মা-বাপ নেই। আমি আবার ঝাল খেকো মানুষ। মিন্ট চায়ের সঙ্গে ওয়াসাবি দেওয়া বাদাম খেতে ভালোই লাগছে। কিন্তু অস্থির ভাবটা কমছে না। কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

বিটনারের সঙ্গে লেখিকা
বিটনারের সঙ্গে লেখিকা

মিসেস বিটনারের গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছি। টেনিস কোর্ট থেকে ফিরলেন বোধ হয়। তার বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। তারা সপ্তাহান্তে এক জোট হয়ে আড্ডা দেন। এখন আর তাদের টেনিস খেলা হয় না। কারও হাঁটু ব্যথা, কারও হার্টের সমস্যা। তবুও টেনিস কোর্টের পাশে বসে কফির কাপে আড্ডাটা ভালোই জমে। আমার এত কিছু জানার কারণ হলো, আমাকে একদিন ধরে নিয়ে গিয়েছিল মিসেস বিটনার। আমি একটু বেশি মাত্রার ঘরকুনো। এটা তার চোখে পড়ার পর থেকে আমাকে জোর করে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়াটা তিনি একটা দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন।
এই বাড়িতে ভাড়া থাকি আজকে প্রায় চার মাস। বিটনারও ভাড়া থাকেন। তিনি ফার্স্টহ্যান্ড ভাড়াটে। আমি সেকেন্ডহ্যান্ড। তাঁর ভাড়া করা একতলার একটা রুম নিয়ে আমার রাজত্ব। রাজত্ব বলছি এ কারণে, নিজের রাজত্ব ছাড়া কেউ এত এলোমেলো থাকার সাহস পায় না। প্রথম প্রথম ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতাম। এখন আর সম্ভব হয় না। সময়ের অভাব। মুশকিল হচ্ছে প্রায়ই ঘরে ফিরে দেখি বিছানাপত্র সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা। বুঝতে অসুবিধা হলো না কার কাজ। এক সন্ধ্যায় বিটনারকে বললাম, দেখো, কোনো দরকার নাই কষ্ট করে আমার জিনিসপত্র গোছগাছ করা। এটা তো আমি নিজেই করতে পারি।
কয়েক দিন পর আবিষ্কার করলাম বাথরুমে আমার চুল মোছার তোয়ালেটা ধুয়ে ভাঁজ করে রাখা। মহা যন্ত্রণা। কিন্তু বুঝলাম, বলে লাভ নেই। জার্মানদের মাথায় কিছু একটা ঢুকে গেলে সেটা থেকে বের করা মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। মাঝখান থেকে আমার মধ্যে ভাড়াটে ভাব চলে গিয়ে একটা পোষ্য-পোষ্য ভাব চলে এসেছে। বিটনার আমার রুম ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে ক্লিন করে দেন। তোয়ালে ধুয়ে দেন। বিছানাপত্র পর্যন্ত ঠিকঠাক করে দেন। পোষ্য-পোষ্য না লাগার তো কোনো কারণ নেই।

লেখিকা
লেখিকা

সেদিন বুধবার রাতে খেয়েদেয়ে থালাবাটি ডিশ ওয়াশারে ঢোকাচ্ছি, এমন সময়ে তিনি হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘এই উইকএন্ডে কি তোমার টাইম হবে? তাহলে চল চাইনিজ খেয়ে আসি। একজনের পয়সায় দুজন খাওয়া যাবে, এই অফারটা আবার দিচ্ছে ওরা।’ তাকিয়ে দেখলাম তাঁর হাতে কুপন। এর আগে তাঁর সঙ্গে বার দু-এক যাওয়া হয়েছে ওই রেস্তোরাঁয়।
আমার ধারণা মাসে একবার রেস্তোরাঁয় কুপন ছাড়ে আর বিটনার খবরের কাগজ থেকে কুপন কেটে বসে থাকেন দ্বিতীয় কাউকে জোগাড়ের ধান্দায়। আর গত কয়েক মাস যাবৎ এই দ্বিতীয় কেউটা হচ্ছি আমি! যা হোক, আজকে আমার খাদ্য ভাগ্য মনে হয় ভালোই যাবে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে রেডি হচ্ছি। বিষণ্ন সন্ধ্যাটাকে আর বিষণ্ন মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সয়াসসের ঘ্রাণে ভরপুর এক চাইনিজ সন্ধ্যা।

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।