বৈরুতে নানা রঙে বৈশাখ উদ্যাপন

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

বাংলাদেশের অনুষ্ঠান কোথায়? রাস্তায় গাড়ির কাচ নামিয়ে একজন লেবানিজ জানতে চাইলেন। পাঞ্জাবি পরে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি মশিউর রহমান হাসিমুখে হাত দিয়ে দেখালেন অনুষ্ঠানস্থলটি কোন দিকে। শুকরান (ধন্যবাদ) বলে হাসিমুখে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন সরাসরি অনুষ্ঠান স্থলে। এ ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে পথনির্দেশ দিতে দেখা গেল কয়েকজন প্রবাসীকে। নিজেরাই স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করছেন নববর্ষের অনুষ্ঠানে আগত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

লেবাননের বৈরুতে বৈশাখী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। বিশাল খোলামাঠ ছেড়ে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এবারের নববর্ষের অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বৈশাখী মেলার আয়োজন। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন সেখানে। ১০টি দোকান দিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তারা বিক্রি করেছেন বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি খাবার। চটপটি, ঝালমুড়ি, শিঙাড়া, সমুচা, জিলাপি, হালিম ও পিঠা ইত্যাদি। একেকটি দোকান যেন একেকটি আনন্দের জায়গা। প্রতিটি দোকানে বেশ জটলা। সবাই বাসায় বাংলাদেশি খাবার খান কিন্তু এখানে এত আয়োজন। সব মিলে এক আনন্দযজ্ঞ। ঠোঙায় করে ঝালমুড়ি খাচ্ছেন কেউ কেউ। পান্তা ভাত খেতে দেখা গেছে অনেকে ছেলেমেয়েদের। একটি স্টল ছিল মুখে বৈশাখী আলপনা আঁকার জন্য। মেয়েরা পরেছে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। ছেলেরা সকলেই পাঞ্জাবি।

কবিতা আবৃত্তি করেন আব্দুল মোতালেব সরকার
কবিতা আবৃত্তি করেন আব্দুল মোতালেব সরকার

রঙ্গভরা বৈশাখ বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমনটি ছিল বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত লেবাননের বৈশাখের অনুষ্ঠানে। প্রায় সাত শ বাংলাদেশি একসঙ্গে উপভোগ করেছেন বৈশাখের অনুষ্ঠান। উপভোগ করেছেন তিন ঘণ্টা ধরে প্রবাসীদের গান। দূতাবাসের সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনা মুগ্ধ করে সকল প্রবাসীদের। সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনা ছিল পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে। পয়লা বৈশাখের দিন লেবাননে কর্মদিবস থাকার কারণে গত রোববার (২২ এপ্রিল) জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্‌যাপিত হলো বাংলা নববর্ষ। অনুষ্ঠানের দিন বাংলাদেশির এক মিলনমেলায় পরিণত হয় বৈশাখী অনুষ্ঠানস্থল।
লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোতালেব সরকার শুভেচ্ছা বক্তব্যে সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। তিনি সংক্ষেপে বাংলা বছরের ইতিহাস ও বিবর্তন তুলে ধরে বলেন, বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন বাঙালির সবচেয়ে বড় ও সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। একে বাঙালির প্রাণের উৎসবও বলা যায়। তিনি বাংলা বর্ষবরণে অনুষ্ঠানকে আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, এ দিনটিতে আমরা সকলে মিলে-মিশে আনন্দ-উৎসবের মধ্যে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা লাভ করি। বাংলা বর্ষবরণ উৎসব বিগত বছরের দুঃখ ও গ্লানি মুছে দিয়ে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি নতুন বছরে সরকার ও দেশের সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করেন এবং নতুন বছরে লেবানন ও সাইপ্রাসের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশি খাবারের সামনে অতিথিরা
বাংলাদেশি খাবারের সামনে অতিথিরা

সাংস্কৃতিক পর্বের অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানার আগে দূতাবাসের নিজস্ব সাংস্কৃতিক দল গঠনের গল্প পাঠকের জানা প্রয়োজন। লেবাননে মূলত দুই ধরনের ভিসায় বাংলাদেশি কর্মীরা আসেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও গৃহকর্মী। বাংলাদেশ থেকে যারা আসেন তারা মূলত অল্প শিক্ষিত মানুষ। খুব সহজ সরল ও বোকা। অনেকে নিজের নামটা পর্যন্ত লিখতে পারে না। পাসপোর্টে নিজের নাম কি আছে তাও পড়তে পারেন না। তাদের অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। এ সব সমস্যা সমাধানে বর্তমান রাষ্ট্রদূত মনে করলেন কিছু করা প্রয়োজন। সবার কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যদি সবাইকে আনা যায় তাহলে এই সমস্যা খানিকটা লাঘব করা সম্ভব। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর দূতাবাসে প্রবাসী শিল্পীদের জন্য গানের অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কবিতা সন্ধ্যা, গান ও সিনেমা দেখারও আয়োজন করা হয়েছে।

বাংলাদেশি খাবারের সামনে অতিথিরা
বাংলাদেশি খাবারের সামনে অতিথিরা

যা হোক, এবারের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় বিশাল খোলা মাঠে। যেখানে কয়েক হাজার মানুষ সহজেই চলাফেরা করতে পারেন। এবারে মেলাতে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। খোলা মাঠে আয়োজন করার ফলে মেলার স্থান পরিণত হয় এক টুকরো বাংলাদেশে। অনেকে শুধু মেলাতে অংশগ্রহণ করার জন্য ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছিলেন দূতাবাসের বৈশাখী এই আয়োজনে। সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনায় ছিল প্রায় ৩০টির মতো কবিতা, দলীয় সংগীত, ভান্ডারি, বাউল গান, বৈশাখী গান, আধুনিক গানসহ বিভিন্ন পরিবেশনা। প্রবাসী শিল্পীদের মধ্যে গান পরিবেশন করেন শাহরিয়ার, সাঈদ, ইমতিয়াজ, মমতাজ, রিংকু, লিটন, রায়হান ও মহম্মদ লাবলু শামীমসহ আরও অনেক প্রবাসী শিল্পীরা।

বাংলাদেশি খাবার হাতে অতিথিরা
বাংলাদেশি খাবার হাতে অতিথিরা

সাংস্কৃতিক পর্বের অন্যতম আকর্ষণ ছিল রাষ্ট্রদূতের কবিতা আবৃত্তি। তিনি আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি। কাউন্সেলর ও দূতালয় প্রধান সায়েম আহমেদ আবৃত্তি করেন জীবনানন্দ দাসের কবিতা বনলতা সেন। প্রবাসী রুবেল আহমেদ, মশিউর রহমান, আতাউর রহমান, আব্দুল করিমও আবৃত্তি করেন।
সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই দুই দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। বৈরুত দূতাবাসের তৈরি বৈশাখী প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয় অনুষ্ঠানস্থলে বড় পর্দায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সায়েম আহমেদ।
এ ছাড়া মেলায় আগত সকল প্রবাসী এবং স্থানীয় ও বিদেশি অতিথিদের জন্য দূতাবাস বিভিন্ন খাবারের বিশাল আয়োজন করে। তারা প্রাণভরে উপভোগ করেন হরেক রকমের বাংলাদেশি খাবার। এ যেন বাংলাদেশের মেজবানি ভোজ। অনেক বিদেশিদের দেখা যায় বাংলাদেশি খাবার আনন্দের সঙ্গে খাচ্ছেন। প্রতিটি স্টল ঘুরে দেখছেন।
বৈশাখী মেলাতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, লেবাননেরে নৌবাহিনী প্রধানসহ লেবাননের সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

উপস্থিতির একাংশ
উপস্থিতির একাংশ

জুবায়ের করিব: বৈরুত, লেবানন।
ছবি: সাগর হাওলাদার, জহির রায়হান ও বাবু সাহা।