কালো ঘুড়ি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ড্রাইভওয়েতে এসে আবিদ আর গাড়িটি তুলতে পারে না। ঠায় স্থির হয়ে থাকে। এমন না যে ওর গাড়িতে কোনো সমস্যা আছে। এখনো দিব্যি আট-দশ বছর চোখ বুঁজে চালানো যাবে। মাত্র তো চল্লিশ হাজার মাইল চালিয়েছে। ইঞ্জিনে কোনো বাজে আওয়াজও নেই। নিয়মিত যত্ন করে বলে গাড়ির ভেতর-বাইর বেশ ঝকঝকে। সাধারণত আমাদের ওদিককার লোকজন জাপানি গাড়ির বাইরে অন্য কোনো দেশের ব্র্যান্ডেই যান না। তার সে সমস্যা নেই। প্রথম থেকেই সে আমেরিকান গাড়ি চালিয়ে এসেছে। কোনো ঝামেলায় পড়েনি। ওর এবারেরটা ফোরড এসকেপ। পরিবার বড় হচ্ছে। তাই একটু বড় গাড়ি দরকার হয়ই। আর তা ছাড়া ওকে প্রায়ই নর্থ শোর কিংবা দুলুথে যেতে হয়। গাড়ির ভেতরেও খানিক বেশি জায়গা প্রয়োজন। বড় গাড়িতে তাই মেলা সুবিধা।

পার্কিং গিয়ারে বসে সে জোরে জোরে গ্যাসে চাপ দেয়। জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে এসকেপ ‘বুম-বুম’ করে ওঠে। অমন শব্দে তো ওটির উড়ে যাওয়ার কথা। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ওটার নড়ার কোনো লক্ষণই নেই! বরং গ্যারেজের দিকে ফিরে কেমন হেলে দুলে চলছে! যেন কোনো শব্দই পাচ্ছে না। পাখিরা বধির হয় নাকি? কি নাম পাখিটার? দেখতে অনেকটা কানি-বকের মতো, কেমন ধূসর পালক। লম্বা ঠোঁট। ওদের গ্রামের বাড়িতে এ ধরনের পাখিকে বলে ‘বগলা’। পাখিটি এইবার ওর গাড়ির দিকে ফিরে তাকায়, স্থির দৃষ্টি। মাথাটা একদিক থেকে হঠাৎ করে অন্যদিকে ঝাঁকায়। সেদিকে তাকিয়ে আবিদের নিশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে ওঠে। ওটির চোখে চোখ পড়তেই কেমন হিম শীতল একটা অনুভূতি হয় তার। সে হাত দিয়ে কোমরের ডান পাশে জিনিসটা অনুভব করার চেষ্টা করে। নাহ, ঠিক জায়গা মতোই আছে সেটি। ওর মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে। সে এখন কী করবে? দেবে নাকি ফেলে। এত কাছ থেকে লক্ষ্য মিস হওয়ার কথা নয়। তার হাতের টিপ প্রায় অব্যর্থ। বহুকালের অধ্যবসায়ের ফল, বিফলে যায় কী করে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এটা তো ওর প্রতিবেশ। গুলির শব্দ শুনে নানা ফ্যাসাদ তৈরি হবে। বলা যায় না প্রতিবেশীরা টেররিস্ট-অ্যাটাক বলে নাইন-ওয়ান-ওয়ানে ফোনও করে দিতে পারে। ঝামেলা আরও একটা আছে। তার ড্রাইভিং সিট থেকে পাখিটার মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালালে তা সরাসরি গিয়ে ওর গ্যারেজের রোলিং-ডোর ছ্যাদা করে দিতে পারে। ওটা একটা বেশ ভালো ক্ষতির কারণ হয়ে যাবে তখন। কিন্তু কি করবে এখন সে? তার যুক্তিবোধ যথার্থ মাত্রায় কাজ করছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। অথচ গাড়ি চালিয়ে সামনের দিকে গেলেই তো ওটা উড়ে যাওয়ার কথা। এই কাজটাও করতে পারছে না আবিদ। ঠিক তখন ঝিলিকের মতো মাথায় একটা খেয়াল আসে। সে বাসায় ফোন করে। ওপাশে তিথি ফোন ধরে। আবিদ বলে, অরাকে একটু বাইরে পাঠাও তো।
—কেন? কি দরকার?
—বাজারগুলো নামাতে হেল্প করবে। জলদি পাঠাও।
—কি আর এমন বাজার যে ওকে লাগবে? আচ্ছা পাঠাচ্ছি।
অরা এসে গ্যারেজের ভেতর থেকে দরজার বোতামে চাপ দেয়। দরজাটি ঘড়ঘড় শব্দ করে আস্তে আস্তে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপরে উঠে যায়। গাড়িটি গ্যারেজে ঢোকানোর সময় পাখিটিকে আর নজরে পড়েনি তার। উড়ে গেল নাকি? কিন্তু সে দেখেনি কেন? আসলে কি কোনো পাখি ছিল ওখানে? নাকি সেটা তার দেখার ভুল? আরেকটি ব্যাপার এইমাত্র তার মনে হলো। সে-ও তো গাড়িতে বসেই রিমোট টিপে দরজা খুলতে পারত! আর তাতে অনায়াসেই পাখিটি উড়ে যেত। কোনো হ্যাপাই হতো না। এই যেমন এখন সেটা হাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এই চিন্তাটা একটু আগেও তার মাথায় কাজ করেনি, কেন? আজব তো!
মেয়েকে গোপন উপহার দেওয়ার ভান করে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয় সে। অরা ভ্রু কুচকে জানতে চায়, হোয়াটস দ্যাট?
—খুলে দ্যাখ।
প্যাকেটটি খুলতে খুলতে ওর মুখের রেখা বদলাতে থাকে। সরলতার অভিব্যক্তির তুলনা হয় না বুঝি। সে জোরে চিৎকার করে ওঠার আগেই আবিদ বলে, ডোন্ট স্ক্রিম, ইয়োর মাম উইল বিট ইউ অ্যান্ড মি আপ। আমি পেঁয়াজ আনতে ভুলে গেছি। তুই ব্যাগগুলা একটু ধর। আমি কস্টকো থেকে চট করে এক ব্যাগ পেঁয়াজ কিনে নিয়ে আসি, কেমন।
অরাকে দেখে মনে হলো না, বাবার কথা খুব একটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে সে। বাজারের ব্যাগগুলো নিস্পৃহভাবে নেয়। তার পুরো নজর জুড়ে আছে হাতের চৌকোনা প্যাকেটটি। একটা দুরবিন, তার অনেক দিনের শখ।
আবিদ ওর এসকেপ নিয়ে আবার বেরিয়ে যায়। দেখে রাস্তা একদম পরিষ্কার। ঝলমলে একটা দিনের শেষ বেলা। অক্টোবরের আকাশ কাচের মতো, মেঘহীন-বর্তুল। রোদ ক্রমশ হলদেটে-কমলা রঙের হতে শুরু করেছে। সে রোদ ঘাড়ে এসে পড়ে, ভালো লাগে তার। আশপাশের গাছে একটিও পাতা নেই। আর কদিন বাদেই নেমে আসবে হিমশীতল ঠান্ডা। প্রথম প্রথম অনেক অসুবিধা হতো তার। চারদিক এত তুষার পড়ে মিনেসোটায়, কেমন অস্থির অস্থির লাগত তার। অথচ আস্তে আস্তে এই সাদা বরফের রাজ্যই ভালো লাগতে শুরু করে। এখন তো চারপাশে বরফের পাহাড় না জমলেই বরং মনটা দমে যায়। কেমন মনমরা লাগে। বাংলাদেশের মতো অমন একটা চিটচিটে গরমের দেশ থেকে এসেও দিব্যি মানিয়ে গেছে সে। মানুষ কী তবে পাল্টায়? সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে? কে জানে।
চিন্তার মোড় অন্যদিকে ফেরাতে চেষ্টা করে আবিদ। অফিসের কথা ভাবে। আজ একটা ঘটনা ঘটেছে। ওদের আগের ম্যানেজার পাল্টে নতুন একজন এসেছেন। লোকটি ভারতীয়—বেঙ্গালুরুর। ভেংকটেশ না কী যেন একটা নাম। আজ প্রথম দিন থেকেই ওর অন্যান্য কলিগরা অনায়াসে মি. ভি বলে ডাকতে শুরু করেছেন। অথচ সে তা বলতে পারেনি। তার আগের বস ছিল চিঙ্কু—চাইনিজ। কঠিন পরিশ্রমী আর হাড় বজ্জাত। সারাক্ষণ পেছনে টিকটিক করত। প্রতি সপ্তাহের সোমবার সকালে বসত ওদের ৩০ মিনিটের মিটিং। সেখানে তার চাইনিজ বস চ্যাং (সব চিঙ্কুর নামই কী চ্যাং নাকি) রাজ্যের অনুপাত, কর্মক্ষমতার ক্রম হ্রাস কিংবা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে আঙ্কিক বিশ্লেষণে বসত। ওসব ম্যাথমেটিক্যাল এনালিসিসের সে ছাই কিছুই বুঝত না। শুধু মিটিং শেষে ওদের দলের সবার চোখ-মুখ দেখে বোঝা যেত, হাওয়া গরম। প্রতি সোমবার সকাল ছিল তাই তার বিভীষিকার দিন। মনে মনে দিন গুনত কবে না তাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘কাল থেকে তোমার কাজে আসার আর দরকার নেই’। আগে হলে তেমন ভাবত না। কাজ গেলে যাবে, আরেকটা জুটিয়ে নেবে। কিন্তু আজকাল একটু একটু করে চিন্তা কাজ করে। কাজের বাজারটা এখনো তেমন ভালো হয়ে ওঠেনি। এইতো শরিফের চাকরিটা হুট করে চলে গেল। আজ ছয় মাস, এখনো ওর কোনো ভালো কাজ জোটেনি। সামনের বছর অণল কলেজে যাবে। ওর জন্য কিছু সঞ্চয় থাকাটা জরুরি। এখন অণল যদি একটা ভালো স্কলারশিপ পায় তবে সে উতরে যায়।
সেদিক থেকে ভারতীয় ম্যানেজার বুঝি খারাপ হবে না, আবিদ ভাবে। এসেই প্রথমে সবাইকে নিয়ে একটা শিথিল আয়েশি সভা করল। সবার কথা শুনল। কফি খেতে খেতে একটা ছোট্ট ভাষণ দেয় ভেংকটেশ।
...কেন আমেরিকা একটি মহান দেশ তা এখানকার এই ছোট্ট টিমটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এগারো জনের এই দলে তুমি দেখবে পৃথিবীর নানা ভূখণ্ডের চিত্র। যেন একটা ফুলের বাগান। এ দেশে আমরা যেমন পারস্পরিক সহাবস্থান করি তেমনি নিজেদের ফেলে আসা দেশের সংস্কৃতিও বিনিময় করি। গতিশীলতা ও সহনশীলতার এমন নিদর্শন আর কোথায় পাবে, বল? প্রোডাকটিভিটির দিক দিয়ে তাই ইউএস শীর্ষে। মজার ব্যাপার হলো আগে তোমাদের দলে একজন ভারতীয় ছিল, আজ থেকে দুজন হলাম। আমাদের এই দলটি প্রকৃত অর্থেই এ মহান দেশের একটি প্রতীকী সংস্করণ এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের এই অভিযাত্রা একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েই থাকবে। তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। …
মিটিং শেষে প্রত্যেককেই বেশ হৃষ্টচিত্ত মনে হলো। লোকটি কথা বলে চমৎকার, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। তবুও একটি বিষয়ে আবিদের খটকা রয়েই যায়। ভেংকটেশ বলল তাদের দলে দুজন ভারতীয়। তার জানা মতে আর কোনো ইন্ডিয়ান নেই ওদের দলে। ভেংকটেশ আসাতে সে-ই প্রথম সংযোজন। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কে? তবে কি আরও কেউ আসছে নাকি? হবে হয়তো, কে জানে। আসলেই কী আর না আসলেই বা কী? তাতে তার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু ওর চিন্তাটা উসকে দিল ড্যান। লাঞ্চ ব্রেকে দুজনে একসঙ্গে বসে কফি খাচ্ছিল। ড্যান বেশ রসিকতার ছলে বলে, তোমাদের দেশের মানুষকে আমার কাছে একই রকম লাগে, বিড। আলাদা করতে পারি না।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

—কি রকম? অবশ্য প্রথম প্রথম এ দেশে এসে আমারও একই দশা ছিল। এখন বেশ চিনে যাই। কিন্তু তোমার এটা মনে হলো কেন?
—এই যে মি. ভি আর তুমি তো একই দেশ থেকে এসেছ, দেখতেও প্রায় একই রকম। প্রথমে দেখলে মনে হয় তোমরা যেন যমজ ভাই, হা হা হা।
—আরে দূর, কী যে বল না তুমি ড্যান! আমাদের মাঝে কোনো মিলই নেই। আমি তার থেকে কমপক্ষে আধ হাত লম্বা। তার চুলে পাক ধরেছে, সে চশমা পড়ে, আমি পড়ি না। তার গোঁফ আছে, আর আমার ময়দান সাফ। কত পার্থক্য!
—তবুও, তোমাদের দেশের মানুষকে আমার কাছে একই রকম মনে হয়। বিদেশের মাটিতে একই দেশের বস পাওয়া কিন্তু বেশ সৌভাগ্যের বিষয়, কি বল?
—হা হা হা, ভালো বলেছ। ওয়েট অ্যা সেকেন্ড, আমরা কিন্তু একই দেশ থেকে আসিনি। দুজন দুই দেশের। হি ইজ ফ্রম ইন্ডিয়া অ্যান্ড আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ, এ নেইবারিং কান্ট্রি অফ ইন্ডিয়া।
—ও, তাই নাকি। কিন্তু মি. ভি যে বলল তোমরা দুজনেই একই দেশ থেকে এসেছ! তুমি কি খেয়াল করোনি? সে কি জানে না যে তুমি অন্য দেশের?
কথাটি ঝাঁ করে মাথায় ঢুকে যায় ওর। বুঝতে পারে ভেংকটেশ আসলে তাকেও একই দেশের ঠাওরেছে। তবে কি বেঙ্গালুরু আর বাংলাদেশেই এই গুবলেট? তার অস্বস্তি লাগতে থাকে। পরে কখনো ব্যাপারটা খোলাসা করে নিলেই হলো, সমস্যা কোথায়? অথচ সে চিন্তা থেকে আবিদ সহজেই মুক্তি পায় না। বেঙ্গালুরু নয়টি ইংরেজি অক্ষর আর বাংলাদেশে দশটি। তার মাঝে সাতটিতেই মিল, কমন অক্ষর। হলেও তো উচ্চারণে কত ফারাক। আর মিটিংয়ের শুরুতেই তো সে বলেছে যে, সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। একবারও বলেনি ‘ব্যাংলাডেশ’। তবে এই সংশয় কেন? তাহলে কি ভেংকটেশ বোঝেনি ওর কথা? নাকি সে ইচ্ছে করেই অমনটা করেছে? এত দিনেও ওর ইংরেজি উচ্চারণ কি তবে ঠিক হয়নি? কাজের সবাই কিন্তু ঠিকই বোঝে ওর কথা। নিকোলাস প্রায়ই বলে, ‘হেই বিড, ইউ স্পিক ভেরি ওয়েল। ইয়োর ইংলিশ ইজ জাস্ট পারফেক্ট, ডুড। আই ওয়ান্ডার ইফ ইউ হ্যাড টু স্পিক ইংলিশ ইন ইউর কান্ট্রি!’ এই ধরনের প্রশংসা বাক্য প্রায়ই শোনে সে। তবু আজ আবিদের অস্বস্তি কিছুতেই কমে না।
সপ্তাহের অন্যান্য রাতে আবিদ জলদি জলদি ঘুমিয়ে পড়ে। কেবল শুক্রবার ছাড়া। শুক্রবার রাতে সে নিজের কিছু কাজ করে। গরমের সময় গ্যারেজ সাজায়। সাইকেলগুলো পরখ করে দেখে, সব ঠিক আছে কিনা। গত প্রায় এক যুগ ধরে এমএস ১৫০ সাইকেল র‍্যালিতে অংশ নিয়ে আসছে সে। এই আয়োজনে তার নেশা ধরে গেছে। না গিয়ে পারে না। কিন্তু সে তো সামারের শুরুতে। এখন সে পর্বের মুলতবি। পরের বছরের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখানকার গরমের সময়টা এত ছোট!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তবুও আবিদ বসে থাকে না। এই সময়গুলোতে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে, সে তার বন্দুকগুলো পরিষ্কার করে। ওর একটা টিম্বার ক্ল্যাসিক মারলিন থ্রিথ্রিসিক্স-সি, আরেকটা নয় এমএম টরাস হ্যান্ড গান আছে। মারলিনটি সে হরিণ শিকারে ব্যবহার করে। এটি আসলে কিছুটা মৌসুম নির্ভর, সব সময় দরকার পড়ে না। তাই মাঝে মাঝেই পরিষ্কার করে সে। এই যেমন আজ করছে। পাশাপাশি পিস্তলটিও মনোযোগ দিয়ে পরিষ্কার করে। যদিও তার তেমন দরকার হয় না। এই যন্ত্রটি তার অতি প্রিয়, সব সময় সঙ্গে সঙ্গে রাখে। প্রায় প্রতি উইকএন্ডেই অনুশীলনে যায়। বেশ পুরোনো হয়ে গেছে, ওটার স্প্রিং কিছুটা ঢিলে হয়ে গেছে। মেলা দিন ব্যবহার করেছে সে। বদলানো দরকার। বাজারে কত যে সুন্দর সুন্দর জিনিস এসেছে, দেখলেই কিনতে ইচ্ছে করে। অথচ পুরোনো টরাসের জন্য ওর মনটা কেমন যেন করে। আশ্চর্য, একটা পুরোনো অস্ত্রও বুঝি পেছন থেকে খামচে ধরে!
আরেকটি বিশেষ কাজ করে সে। কিছুটা ছেলেমানুষি খেয়াল যদিও, তবু করে। নিয়ম করেই করেই করে বলা যায়। আর তা হলো, পত্রিকার পাতায় ওপর-নিচে, পাশাপাশি চৌকোনা ঘরের শব্দ মেলানো। এ কাজটি সে করে আজ বহুকাল। দেশে থাকতে বাংলা পত্রিকা পেত, মনের সুখে সেটা করতে পারত। কিন্তু এখানে এসে তো তা সম্ভব হয়নি। সে নেশার জন্য সে তাই ইংরেজি পত্রিকাতেই ঘাই মারত। পারুক বা না পারুক। এখন তো অন-লাইনে দেশের পত্রিকা চলে আসে হাতের মুঠোয়। তাই তার হয়েছে বেজায় মজা। কিন্তু আজ কিছুতেই মেলাতে পারছে না সে। কেন পারছে না?

দুই.

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে সে। কিছুক্ষণ স্থির থেকে বোঝার চেষ্টা করে, সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছিল? নাকি এমনি এমনি ঘুম ভেঙে গেছে তার? কিন্তু কার্যকারণ ছাড়া তো কিছুই ঘটে না। একটা অস্বস্তি টের পায় সে। সেটা কি ঘুমানোর আগে শব্দ না মেলানোর জন্য? সে তো নিছক খেলা! নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? কোনো পুরোনো ভাবনা হয়তো ওর মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। কিছুতেই সে রহস্যের কিনারা করতে পারে না। তবে বোঝে ঘামে বিছানাটা ভিজে একাকার।
গায়ের গেঞ্জিটা খুলে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বেশি বরফ দিয়ে এক গ্লাস পানি খায়। অন্ধকার লিভিং রুমে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে আবিদ। ঠান্ডা গ্লাসে চুমুক দেওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনীতে কেমন একটা তীক্ষ্ণ টনটনে ব্যথা অনুভব করে। এটা কেন? আবছা আলো আঁধারের জন্যই কিনা কে জানে, সে যেন শোনে, অযুত-নিযুত কাকের কর্কশ গলা। ইলেকট্রিকের তারে বসে তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে। বিরাম নেই। আকাশ জুড়ে কালো কালো মেঘ। সে মেঘ বুঝি তার মাথার ভেতর। মেঘে মেঘে শব্দেরা ভেসে যাচ্ছে। সে যেন কিছুতেই ধরতে পারছে না।
তবে কি সে সত্যি সত্যি স্বপ্ন দেখছিল? তা সে দেখলেই বা কী? লোকে বুঝি আর খোয়াব দেখে না? বিষয়টা নিয়ে ভাবা দরকার। আগে হলে ফস করে হয়তো একটা সিগারেট ধরিয়ে বসত। কিন্তু প্রকৃত ধূমপান সে ছেড়ে দিয়েছে বহুকাল। এখন সে ই-সিগারেটে অভ্যস্ত। নাহ, এখন আর ওসবে যাবে না সে। এক কাপ কফি বানিয়ে খাবে নাকি? সে চিন্তাটাও বাতিল করে দেয় আবিদ। তার যুক্তিবোধ কাজ করতে শুরু করেছে। এই শেষ রাতে খুটুস খাটুস শব্দে তিথি উঠে যেতে পারে। তখন হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তাকে। তার চেয়ে চুপচাপ মটকা মেরে পড়ে থাকলে ঠিকই একসময় ঘুম এসে যাবে। আর ঘুম না এলেও সমস্যা তো নেই। শুয়ে শুয়ে ঘুম ভেঙে যাবার কারণ নিয়ে ভাবা যাবে। কাল তো শনিবার। এত জলদি ওঠার তাড়াও তো নেই।
অথচ বিছানায় এসে দেখে তিথি জেগে গেছে। চোখ খুলে ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে ওর বুকে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ঘুম ভেঙে গেল?
আবিদ অস্ফুট গলায় বলে, হুম।
—কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছ?
—জানি না। কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। হঠাৎ করে বেশ পানি পিপাসা পেল। গরমও লাগছিল বেশ। বাট দিস ইজ অলরেডি অক্টোবর, গরমের বালাইই নেই।
—তোমার আসলে ডিয়ার হান্টিং-এ যাওয়া উচিত। কবে থেকে সিজন শুরু?
—নেক্সট উইক।
এরপর আর কথা হয় না ওদের মাঝে। দুটো মানুষ প্রায় পুরোপুরি দুটো আলাদা অনুভূতি নিয়ে পাশাপাশি চুপচাপ নিথর হয়ে পড়ে থাকে। তিথি দেখে জানালার বাইরের ফটফটে পরিষ্কার আকাশ। সেখানে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ। তারই হলদেটে আলো জানালা গলে ঘরে ঢুকে পড়েছে। আর আবিদ যেন টের পায় অযুত নিযুত পাখি চারপাশে ডানা ঝাপটাচ্ছে। অথবা সেটা বুঝি তার মাথার ভেতরেই। যেন সে পক্ষীকুল অনবরত ডেকে চলছে। অদ্ভুত শব্দ আর আলোর খেলা। বাকিটা রাত ওরা দুজনের কেউই ঘুমোতে পারে না। (চলবে)

আসাদুজ্জামান পাভেল: অরেঞ্জবার্গ, সাউথ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র।