দুই মানবী

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গাজীপুরের গজারি বনে এক ছোট প্যান্ডেলের নিচে বসে আছি। অফিসের পিকনিক। নিজের অফিসের না। শাহেদ ভাইয়ের অফিসের পিকনিক। শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় বেশি দিনের না। আরেক বন্ধুর চাচাতো ভাই। আমার তিন চার বছরের বড় হবেন। চোখে মোটা চশমা। মাথার চুল সামনের দিকে পাতলা হয়ে আসছে, বিশেষত্বহীন চেহারা। মানুষটাও ছোটখাটো। তারপরও শাহেদ ভাইকে আমার মতো অনেকে শ্রদ্ধা করেন। কারণ মানুষটা আসলে একটা জ্ঞান সাগর। রাজনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য এমন কোনো বিষয় নেই যার সম্বন্ধে শাহেদ ভাইয়ের কোনো জ্ঞান নেই।

কিছুদিন যাবৎ চাকরি বদলাতে চাচ্ছি। শাহেদ ভাইকেও বলেছি। বলেছিলেন দেখবেন। এর মাঝে এই পিকনিক আসতে বললেন—‘তুই আমার গেস্ট হিসেবে চল। অনেক বড় বড় অফিসার আসবেন। পরিচিত হলে কাজে লাগতে পারে।’ শুক্রবার দিন এমনিতেও আমি কোনো রাজকার্য করি না। তাই রাজি না হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। আর কিছু না হলেও শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প তো করা যাবে। গত আড্ডায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম নিয়ে গল্প বলা শুরু করেছিলেন। আজকে হয়তো আরও শোনা যাবে। কিন্তু সকাল থেকেই দেখছি শাহেদ ভাই ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। ডিজিএমের মাথা ব্যথা। শাহেদ ভাই কোথা থেকে ডিসপিরিন জোগাড় করে এনে দেন। চিফ অ্যাকাউন্ট সাহেবের রৌদ্রে মাথা ঘোরে, তার জন্য ছাতা জোগাড় করে দেন। এখন খাওয়া দাওয়া শেষে প্যান্ডেলের নিচে বসেছি শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে। এক মিনিট পরেই জিএম আসেন।
—শাহেদ। তোমার ভাবির খাওয়ার পরে পান খাওয়া অভ্যাস। সবকিছু এনেছে জর্দা আনে নাই। দেখো কিছু করা যায় কিনা।
—জি স্যার। কোন ব্রান্ডের জর্দা? তেলতেলে গলায় বলেন শাহেদ ভাই।
—আরে এই জঙ্গলে ব্রান্ড খুঁজে লাভ কি? যেকোনো একটা পাও কিনা দেখ।
—ভাবি খাবেন। যাতা জিনিস তো আনা যায় না। একটু হাত কচলাতে কচলাতেই বলেন শাহেদ ভাই।
—দেখো বাবা জর্দা পাওয়া যায় কিনা।
—জি স্যার দেখছি। বলেই কেমন তড়িঘড়ি চলে যান শাহেদ ভাই।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মুখের ভেতরটা কেমন তেতো লাগে। অনেক আগে একটা বিদেশি মুভি দেখেছিলাম। কাহিনিটা এ রকম। এক বাচ্চা ছেলের হিরো তার বাবা। বাবা চালের বস্তা অনায়াসে তুলে নিতে পারেন, দুই হাত ছেড়ে সাইকেল চালাতে পারেন, এমনকি তিনটা বল নিয়ে জাগলও করতে পারেন। তার বাবার চাইতে সাহসী, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান কেউ নাই। থাকতেই পারে না। বাবা ছিলেন আসলে চোর। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ রাস্তায় দেখে দুই–তিনজন লোক তার বাবাকে মারছে। চুরির অপরাধে। মার খেয়ে বাবার কিছুই হয় না। কিন্তু বাবাকে ঘিরে ছেলের দুনিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। অতটা না হলেও শাহেদ ভাই সম্পর্কে...এতটুকু ভাবতে ভাবতে পাশের আসনে কোট প্যান্ট পরা ভদ্রলোক এসে বসেন। দেখে মনে হলো কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমার শাহেদ ভাইয়ের উপদেশ মনে পড়ে।
—খাবারটা কিন্তু বেশ ভালো ছিল। আমি আলাপ শুরু করার চেষ্টা করি। কথাটা শুনে ভদ্রলোক আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। চেহারায় একরাশ বিরক্তি। প্রশস্ত কপালে গুনে গুনে চারটা ভাঁজ।
—আপনাকে তো চিনলাম না।
আমি সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিই। শুনে ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ আরও দুইটা বাড়ে।
—আমি জিএম মার্কেটিং। কোম্পানি তো আসলে আমরাই চালাই। অনেকেই মনে করে সেলস গুরুত্বপূর্ণ। বোকারা মনে করে।
—জি আমিও তাই মনে করি। মার্কেট না থাকলে বেচবে কোথায়। আমি সায় দেওয়ার চেষ্টা করি।
—হুমম। এতটুকু বলে ভদ্রলোক কপালে ভাঁজের সংখ্যা আরও একটা বাড়িয়ে কোর্টের পকেট থেকে কিছু কাগজ বের করে সেটায় মনোযোগ দেন।
পরিষ্কারভাবে বলা-ফালতু লোকের সঙ্গে এর চাইতে বেশি ফালতু আলাপ করব না। তাও আমি পাশে বসে উসখুস করি। আমার উসখুস টের পেয়েই মনে হয় ভদ্রলোক এক–দুই মিনিট পরেই উঠে চলে যান।
আমি আশপাশে তাকাই। প্যান্ডেলের সামনের দিকের চেয়ারগুলোতে সুন্দর পোশাক পরা নারীরা স্থান নিয়েছেন। কখন যেন সামনে একটা ছোট স্টেজও তৈরি হয়ে গিয়েছে। বুঝলাম ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে। এ রকম পিকনিকে সব সময় যেমন হয়। শাহেদ ভাই তখনো মনে হয় বাবা জর্দা খোঁজায় ব্যস্ত। কয়েক মিনিট পরেই মাইক্রোফোন হাতে একটু আগেই আমার পাশে বসা জিএমকে দেখি। অনুষ্ঠান শুরু হয়। জিএম সাহেব চমৎকার কথা বলেন। অল্প সময়েই অনুষ্ঠানকে জমিয়ে তোলেন। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুন্দরী নারীদের খুব চমৎকারভাবে প্রশংসা করতে থাকেন। দুইটা গান হওয়ার পরে জিএম সাহেব নিজেই বনলতা সেন আবৃত্তি করেন। ভরাট গলায় ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য...’। অসাধারণ লাগে। আশ্চর্য ভদ্রলোকের কপালে একটা ভাঁজও দেখা যায় না। কেমন মায়াময় প্রেমময় মুখ।

শাহেদ ভাইয়ের এক তত্ত্বের কথা মনে হয়।
‘এই যে মোরগটা গলা ফুলাইয়া কুক্কুরু বলে ডাকে। সিংহ কেশর ফুলাইয়া গর্জন করে। কেন?’
কয়েক দিন আগেই শাহেদ ভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন।
কেন আবার এমনিতেই। আমি উত্তর দিয়েছিলাম।
‘প্রকৃতিতে কোনো কিছুই এমনি এমনি হয় না। মোরগ কিংবা সিংহ এ রকম করে মুরগি অথবা সিংহীকে খুশি করার জন্য। প্রকৃতিতে নারীকে মোহিত করার জন্য পুরুষকে সব সময়ই রং-ঢং করতে হয়।’
এইটা কি বললেন শাহেদ ভাই। উল্টাটাই তো এত দিন শুনছি।
‘চারদিকে একটু তাকাইয়া দেখিস। যে পেখম তুলে নাচা নিয়ে কবিরা এত কাব্য করেছেন সেটা কিন্তু পুরুষ ময়ূররাই নাচে।’
এসব হয়তো জন্তু জানোয়ারের জন্য ঠিক। কিন্তু মানুষ ভিন্ন। তখন শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক করেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শাহেদ ভাইয়ের তত্ত্ব সঠিকও হতে পারে...এতটুকু ভাবতে ভাবতেই উপস্থাপক জিএম সাহেব অতিথি হিসেবে আমাকে ডাক দেন। স্টেজে। আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাও যেতে হয়। স্টেজে উঠে কেমন নার্ভাস লাগে। জিএম সাহেব আমাকে কিছু একটা করতে-বলতে বলেন। সামনের সারিতে সব সুবেশী সুন্দরী নারীরা বসে। শাহেদ ভাইয়ের তত্ত্বমতে আমারতো কেশর-পেখম কিছু একটা থাকার কথা। এতটা নার্ভাস যে কী করব, কী বলব বুঝতে পারি না...অবশেষে একটা কৌতুক মনে পড়ে—‘দুই মহিলা আলাপ করছেন। ভাবি আমার শাশুড়ি ছিলেন দেবীর মতো। এতটুকু শুনেই অন্য মহিলা বলে ওঠেন, ভাবি আপনি কী লাকি। আমার শাশুড়ি এখনো বেঁচে আছে। হাড়–মাংস জালিয়ে খাবার জন্য। ইসসস কবে যে আমি আপনার মতো বলতে পারব।’
বলা শেষে দেখলাম অনেকেই হাসছেন। সবচেয়ে বেশি হাসছেন উপস্থাপক জিএম সাহেব।
—আর একটা বলেন। উপস্থাপক অনুরোধ করলেন।
একই রকম আরও একটা কৌতুক মনে পড়ল—মলি জলি প্রতিবেশী। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মলি দেখে পাশের জলির বাসায় বেশ ভিড়। গেটের সামনে বেশ কিছু মহিলা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কৌতূহলী হয়ে মলিও গেল। গিয়ে জলিকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।
—কাল রাতে আমার শাশুড়ি মারা গেছেন। জলি উত্তর দিল।
—হঠাৎ। কীভাবে? মলি জিজ্ঞেস করে।
—আরে আমার বাসার বড় কুকুরটা মেরে ফেলেছে শাশুড়িকে।
—ওহ। কী সাংঘাতিক। এখনতো নিশ্চয় তোমরা কুকুরটাকে রাখবে না। আমাকে দিয়ে দাও। মলি অনুরোধের সুরে বলে।
—আরে সেই নিয়েই তো সকাল থেকে ঝামেলা। বাইরে যে লাইন দেখছ ওটা কুকুরটাকে নেওয়ার লাইন। তুমিও লাইনে গিয়ে দাঁড়াও। সিরিয়াল আসলে পাবে।
কৌতুকটা বলে শেষ করলাম। আবার দেখলাম অনেকেই হাসছেন। যথারীতি সবচেয়ে বেশি হাসছেন উপস্থাপক। কিন্তু হঠাৎ দর্শক সারি থেকে এক নারী উঠে দাঁড়ালেন।
—এ রকম কৌতুক শুধুমাত্র পাষণ্ড পুরুষেরাই বলতে পারে। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত। যত সব...বলেই গটগট করে ওই নারী প্যান্ডেল থেকে চলে যান। মুহূর্তে নিস্তব্ধতা নেমে আসে অনুষ্ঠানজুড়ে। লজ্জায় অপমানে আমি কুঁকড়ে যাই।
‘এখন বাচ্চারা একটা গান করবে।’ তাড়াতাড়ি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন উপস্থাপক সাহেব। আমি স্টেজ থেকে কুণ্ঠিত পায়ে নেমে আসি। প্যান্ডেল থেকেও একটু দুরে চলে যাই। একটু পরেই শাহেদ ভাই আসেন।
—ধুর তুই দেখি মন খারাপ করছস। আরে ওই মহিলা এমনই। কারও সঙ্গে কখনো হেসে কথা বলেন না। ডিভোর্সি। হয়তো শাশুড়ির সঙ্গে ক্যাচাল ছিল।
সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন শাহেদ ভাই। আমি কিছু বলি না। ফেরার পথে বাসেও শাহেদ ভাই মজার মজার জিনিস নিয়ে আলাপ করেন। আমি হু-হ্যাঁ করেই শামিল হই। তেমন জমে না আলাপ।
তিন দিন পরেই শাহেদ ভাই ফোন করেন।
—লিলি ম্যাডাম তোকে একটু দেখা করতে বলেছেন? একদিন অফিসে আয়।
—কোন লিলি ম্যাডাম? আমি জিজ্ঞেস করি।
—ওই যে সেদিন পিকনিকে তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন।
—ওহ, আমি যে একটু ব্যস্ত। বলে এড়িয়ে চাই। কয়েক দিন পরে আবারও ফোন করেন শাহেদ ভাই। এবারও ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে যাই।
এর প্রায় মাস তিনেক পরের কথা। ওই ঘটনার কথা তেমন আর মনেও নাই। চাকরিও বদল করে ফেলেছি। নতুন চাকরিতে শুক্র–শনি দুই দিন ছুটি। এক শনিবার কোনো এক কাজে মতিঝিল গিয়েছি। কাজ শেষে ফেরার পথে ভাবলাম শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যাই। অফিসে গিয়ে শুনি শাহেদ ভাই অফিসের কাজে পাবনা আছেন। ফিরে আসব এমন সময় পেছন থেকে নারী কন্ঠের কেউ একজন ডাক দেন—‘এই যে শুনছেন?’
পেছনে ফিরে দেখি সেই লিলি ম্যাডাম আমাকেই ডাকছেন।
—আমাকে ডাকছেন। কাছে গিয়ে বলি।
—জি আপনাকেই। শাহেদকে দিয়ে অনেকবার খবর দিলাম। আপনি আসলেন না। এত রাগ?
—না মানে?
—এত মানে মানে করতে হবে না। লাঞ্চ টাইম প্রায় হয়ে এসেছে। চলেন ক্যানটিনে যাই।
শাহেদ ভাইদের অফিসের ক্যানটিনের খাবার বেশ ভালো। তা ছাড়া এখন আবার কোনো অজুহাতে চলে যাওয়া খারাপ দেখায়। তাই যাই লিলি ম্যাডামের সঙ্গে।
ক্যানটিনে ভিড় তেমন নেই। এক ফাঁকা টেবিলে বসি।
—শুনেছি আপনি শাহেদেরও ছোট। শাহেদ আমারও অনেক ছোট। তুমি করে বলি। আপনাকেও কি তুমি করে বলতে পারি?
—জি পারেন। আমি ছোট করে উত্তর দিই।
—কি খাবে বলো?
—জি আমি তো এত তাড়াতাড়ি খেতে অভ্যস্ত না। শুধু চা হলেই চলবে।
—আরে রাখো। শিঙারা–সমুচা খাওয়ার জন্য পেটে ক্ষুধা লাগে না।
অতএব চা শিঙাড়ার অর্ডার দেন লিলি ম্যাডাম।
—প্রথমেই সরি বলে নেই। সবার সামনে সামান্য দুটি কৌতুক নিয়ে ওরকম ব্যবহার করা আমার ঠিক হয় নাই। লিলি ম্যাডাম বলেন।
—না, না ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নাই। আমি ওই প্রসঙ্গে যেতে চাই না।
—তোমাকে আসলে খুঁজছি আমার একটা গল্প বলার জন্য। যেহেতু সবার সামনে আমি তোমাকে অপমান করেছি তাই এই গল্পটা আমাকে বলতেই হবে।
আমি কিছু বলি না। বেয়ারা এর মাঝে চা শিঙারা দিয়ে গেছে।

—ভার্সিটিতে এসে প্রেমে পড়লাম। শুরু করেন লিলি ম্যাডাম।
—শোভন ছিল প্রেমে পড়বার মতোই এক ছেলে। ভালো ছাত্র। খুবই সুদর্শন। তার চাইতেও বড় ব্যাপার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। শোভনকে পছন্দ করত না এমন মেয়ে ক্লাসে খুব কম ছিল। প্রথম দুই বছর আমার ভালো লাগা নিয়েই কেটে গেল। টের পেতাম শোভন আমি কাছাকাছি থাকলে একটু বেশি উচ্ছ্বসিত থাকে। একদিন শাড়ি পরে অনেক সেজেগুজে ভার্সিটিতে গেলাম। ক্লাস শেষে যথারীতি আট–দশজনের এক গ্রুপ নিয়ে ক্যানটিনে গেলাম। হঠাৎ শোভন বলল ‘আজকে আমার অনেক খুশি লাগছে। আজকে তোরা যা খাইতে চাবি তাই খাওয়াব।’ এটা শোভনের স্বভাববিরুদ্ধ। শোভন কখনোই এতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। আমার বেশ ভালো লাগে। তারপর শিঙারা হাতে নিয়ে ওর গভীর চোখে খুশির ছটা নিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘আজকের শিঙারাটাও অসম্ভব মজা। তাই না লিলি?’ আমার ভেতরে বাঁধ ভেঙে যায়। ভাবি এই ছেলে কবে ঠিকভাবে বলবে সেই অপেক্ষায় আর থাকা সম্ভব না। পরদিনই লাইব্রেরির বারান্দায় বসে মনের অর্গল খুলে দিই। সব শুনে ও বলল আমিতো জানি। আমিও তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি। হয়তো মুখে বলি নাই। কীভাবে ঠিকভাবে মুখে বলতে হয় আমি জানি না।’
স্বপ্নের মতো দিন কাটতে লাগল। একটু থেমে আবার শুরু করেন লিলি ম্যাডাম।
খুব ছেলেবেলায় বাবা মারা গেছেন। স্কুল মাস্টার মায়ের একমাত্র সন্তান শোভন। ইন্টারমিডিয়েট থেকেই শোভন নিজের খরচ নিজেই জোগাড় করে। এসব শুনে টানটা আরও বাড়ে। একসঙ্গে পাস করে দুজনে চাকরিও পেয়ে যাই দ্রুত। বিয়েও করি চাকরি পাওয়ার দেড় বছরের মধ্যেই। তুমি খুব বিরক্ত হচ্ছ। তাই না। কথার মাঝখানে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন লিলি ম্যাডাম।
—একেবারেই নাহ। আমি আসলে আপনার কথার মাঝখানে কোনো কথা বলতে চাইনি। আমি উত্তর দিই।
—আমার শাশুড়ি আধুনিক মহিলা। তখনো চাকরি করতেন। প্রথমে খুব চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে খটমট শুরু হয়। আমি আর শোভন কোথাও বেড়াতে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আসলাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম শাশুড়ি মুখ হাঁড়ি করে বসে আছেন। মুখে একটাও খারাপ কথা বলতেন না। আসলে কথাই বলতেন না। কেমন গুমোট হয়ে থাকতেন। এই গুমোট যে কী অসহ্য তোমরা ছেলেরা বুঝবে না।
—এসব তো সব পরিবারেই একরকম। উনিশ আর বিশ। আমি হেসে বলি।
—তা ঠিক। তবে একমাত্র ছেলে বলে ব্যাপারটা খুব বেশি ছিল। আমি শোভনকে কখনো পছন্দমতো শার্ট প্যান্ট কিনে দিতে পারতাম না। শোভনের পছন্দ নাকি উনিই সবচেয়ে বেশি জানেন। খাবারের ব্যাপারেও তাই। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগত। শোভনকে কিছু বললেও কেমন অসহায় এর মতো চেয়ে থাকতেন। নিজেরই মায়া লাগত। এর মাঝেই আমি প্রেগন্যান্ট হই। সত্যি বলব ওই সময়টায় উনি এত যত্ন করলেন আমার নিজের মাও এতটা করতেন কিনা সন্দেহ। আর এক কাপ চায়ের কথা বলি। আবার চায়ের অর্ডার দেন লিলি ম্যাডাম।
এরপরে আমি অনেক কিছু মেনে নেই...নিলাম। শাশুড়ি অবসর নিয়ে নাতি নিয়ে মেতে উঠলেন। কিন্তু তিন বছর আগে আসল সেই দিন। অনেক দিন আমরা কোথাও বেড়াতে যাই নাই। সেবার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে আমরা সাত দিন কক্সবাজারে বেড়িয়ে আসলাম। শোভনের আগ্রহই বেশি ছিল। রাতের খাবারের শেষে চা খাওয়া শোভনের অনেক দিনের অভ্যাস। চা নিয়ে আসার পরে খুব শান্তভাবে শোভন বলল, ‘আমি মায়াকে ভালোবাসি। কাল সকালে আমি চলে যাব।’ প্রথমে ভাবলাম শোভন ঠাট্টা করছে। কিন্তু জানি এ রকম ঠাট্টা করার মানুষ শোভন না। ‘কক্সবাজারেই বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। পারি নাই...’ আরও কী কী যেন বলছিল তখন শোভন। আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না। এর চাইতে ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোনো বড় অ্যাক্সিডেন্ট হলেও মনে হয় আমি সহজে নিতে পারতাম। দুই–চারবার যে এ রকম কিছু শুনি নাই। এমন না। মায়াকেও চিনি। শোভনের অফিসেই চাকরি করে। তবে অনেক আগে থেকেই জানি শোভনকে অনেকেই পছন্দ করে। এর আগেও আরও দুইটা মেয়েকে নিয়ে এ রকম উড়া কথা শুনেছি। পাত্তা দেই নাই। আমিতো চিনি আমার শোভনকে...হায় মানুষকে কি সত্যিই চেনা যায়। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। শুনে আমার শাশুড়ি আসলেন। অল্প সময়েই বুঝে ফেললেন সব। ছেলেকে কিছুই বললেন না। আমাকে শক্ত হাতে ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। পরদিন সত্যি শোভন চলে গেল। যাওয়ার সময় সামান্য একটা কথাও বলে গেল না। আমার আর বোধবুদ্ধি রইল না...জীবনমৃত যাকে বলে। শাশুড়ি হাল ধরলেন। অফিসে ফোন করে কীভাবে কীভাবে যেন এক মাসের ছুটির ব্যবস্থা করলেন। আমার নাওয়া খাওয়া সবকিছুই নিজের হাতে করাতে লাগলেন। কয়েক দিন পরে এক ঝড় বৃষ্টির রাতে আমার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন...
‘আমি জানি লিলি তোমার মনের মাঝে কী চলছে। ছাব্বিশ বছর আগে আমারও এ রকম হয়েছিল। শুনে একটু চমকে যাই। হ্যাঁ ঠিকই বলছি। শোভনতো তাও তোমাকে জানিয়ে চলে গেল। তোমার শ্বশুর কিছু না জানিয়েই চলে গেছিল। তোমার শ্বশুরের চাকরিতে মাঝে মাঝেই ট্যুরে যেতে হতো। এ রকম এক ট্যুর থেকেই সে আর ফিরে আসে নাই। কিছুদিন পরে শুনেছি সে অন্য জায়গায় সংসার করছে। কী যে কষ্ট কী যে অপমান। আমি ঠিক বুঝতে পারি লিলি। স্কুলের চাকরি নিলাম। তিল তিল করে মানুষ করলাম শোভনকে। আসলে মানুষ করতে পারি নাই। আমাকে ক্ষমা করো লিলি। এরপরে রাতভর ওনার কষ্টের জীবনের গল্প বলে গেলেন। সেটা এতই দুঃখ কষ্টের গল্প যে একপর্যায়ে নিজের কষ্টের কথাই ভুলে গেলাম।
তোমার শ্বশুর তোমাদের বিয়ের তিন বছর আগে মারা যায়। আমি জানি শোভন কখনোই তোমাকে বলে নাই। কিন্তু বিশ্বাস করো লিলি মানুষটাকে আমি অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। মানুষটা যদি একবার ফিরে আসত...’ এভাবেই গল্প শেষ করেন শাশুড়ি।
এই হলো আমার গল্প। যা তোমাকে বলার জন্য খুঁজছিলাম। শাশুড়ি বউয়ের সংঘাতের মূল কারণ যে একই মানুষের প্রতি ভালোবাসা ওটা পুরুষেরা জানে না। আমার কি মনে হয় জানো। পুরুষ আসলে ভালোবাসা বোঝেই না। এখন আমার সংসার ছেলে আর শাশুড়ি নিয়ে। ভাই-বোন, বাবা-মা সবাই আবার নতুন করে জীবন শুরুর কথা বলে। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি। কিন্তু অনেক রাতে যখন বাইরে কোথাও শব্দ হয় আমি টের পাই আমার শাশুড়ি কী এক ব্যাকুল চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী যে মায়া লাগে। বিশ্বাস করো এখন যদি শোভন ফিরে আসে, আমি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব না। কিছুই মনে রাখব না। তোমার কি মনে হয় সে ফিরে আসবে? আকুল ভালোবাসা চোখে নিয়ে লিলি ম্যাডাম আমাকে জিজ্ঞেস করেন।

মোস্তাফিজুর রহমান: ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>