মাগো, মা আমার

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মা, মাগো, আম্মু কত নামের পসরা সাজিয়ে রেখেছি। তোমায় একবার জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ডাকব বলে। তোমাকে নিয়ে কিছু লেখা তো দূরের কথা। ভাবতে গেলেও চোখের কোণে পানি জমে। এতটা মায়ার বাঁধন একমাত্র তোমার সঙ্গেই হতে পারে মা। এ যে নাড়ির বাঁধন, মায়ার বাঁধন, যেখানে সকল অনুভূতি ভোঁতা। তবুও অনুভূতিগুলোকে নাড়িয়ে–চাড়িয়ে প্রকাশযোগ্য করে তোলার জন্য অবিরাম চেষ্টারত আমি।

ছোটবেলায় যখন ভয় পেতাম, তুমি আয়তুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে আমায় জড়িয়ে নিতে আমাকে। মনে পড়ে, দাদুবাড়িতে বাথরুমের গেটে তোমাকে দাঁড় করিয়ে রাখতাম আর দাদুর কাছে ভূত–প্রেতের গল্প শুনে কত জ্বালিয়েছি তোমায়। জানো আম্মু, অজানা অচেনা শহরের যে ঘরটিতে আমি থাকি, আমার খুব ভয় লাগে। খুঁজে ফিরি তোমাকে। তুমিও খোঁজো আমাকে আমি জানি। তাই তো তোমাকে কিছু বুঝতে দিই না। তোমাকে ঘিরে আমার কল্পনাগুলো জমানো একটি পানি ভর্তি গ্লাসের মতো। যেখানে আরেক ফোঁটা পানি দিলেই উপচে পড়বে। কি ভাবছ? আমার থেকে তুমি বেশি অনুভব করো আমাকে? না বোকা মেয়ে, আমি করি। তুমি তো তোমার অন্য ছেলেমেয়ের কাছে ঠিকই মা ডাক শুনতে পাও। কিন্তু আমিতো পারি না মা ডাকতে।
জানো আম্মু, তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন ইউটিউব ঘেঁটে কত কিছু রান্না করে। কিন্তু তোমার মতো হয় না। মায়ের হাতের রান্নার রেসিপি যে সেখানে নেই, মা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির সময়গুলোত যখন বাসায় যেতাম, তুমি কত কিছু রান্না করতে। আর কত রকমের মিষ্টি আর ছানার সন্দেশ আনিয়ে রাখতে। প্রতিবেলাতেই যেন দুধের সর দিয়ে মালাই চা খাওয়ার ইচ্ছার কথা যেন বলতে হতো না, কেমনে বুঝতে সবকিছু মা? বাসায় এখন যখন আমার পছন্দের সব খাবার রান্না হয় তখন যে তুমি মুখ লুকিয়ে কাঁদো তা কিন্তু আমি এই পাঁচ হাজার মাইল দুরে বসেও ঠিকই টের পাই।

লেখিকা
লেখিকা


সারা বছর পড়াশোনা না করে পরীক্ষার সময় পাগলের মতো পড়ার খুব বাজে রকমের বদঅভ্যাস ছিল আমার। প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার আগেই তোমায় ফোন করে বলতাম, ফেল করব, দোয়া করো এই সব। তুমি আমার পাগলামি দেখে হাসতে আর বলতে তুমি শুধু পাস করবা না বরং সবার থেকে ভালো করবা। আমার তো ওইটুকু প্রস্তুতিতে হয়তো শুধু পাস করাই সম্ভব ছিল। কিন্তু তোমার দোয়াতে সব বদলে যেত মা। আমাদের ভাই-বোনদের সকল পরীক্ষাতেই তুমি রোজা রাখতে আর পরীক্ষা চলাকালে কোরআন পড়তে। জানো আম্মু, তোমার কান্নার শব্দ শুনে একদিন ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। খুব ভয় পেয়ে উঠে দেখেছিলাম তুমি তাহাজ্জুত পড়ে মোনাজাতে কান্না করছ। তোমার মোনাজাতের বেশির ভাগটা জুড়েই ছিলাম আমরা ভাই-বোনেরা। আমি সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম, কোনো বিপদ আমাকে ছুতে পারবে না। এখনো যখন কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি, সৃষ্টিকর্তার পরেই তোমাকে অনুভব করি। সাহস পাই মা, ছোটবেলায় যেমন তোমার আঁচলের নিচে খুঁজে পেতাম নিরাপদ আশ্রয়। এখনো তোমার মমতার সেই আঁচল দেখতে না পেলেও অনুভব করি প্রতিনিয়ত।
ঈদে ভাইবোনদের সবারই বড় ধরনের বাজেট থাকত। তুমি কিছুই কিনতে চাইতে না। হয়তো এটা ভেবেই আমাদের কখন কী লাগে! ঈদের আগে পারলারে যাওয়া, মেহেদি কেনা, জামার সঙ্গে মিলিয়ে কানের দুল। এসবের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলে তুমি মা, তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটি তখন কিছু না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারে। তোমার জামদানি শাড়ির প্রতিটি ভাঁজ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, তবুও তুমি পরম ভালোবাসায় রোদে শুকাতে দাও। জামদানি শাড়ি তোমার খুব পছন্দ, তাই না আম্মু? স্বপ্ন দেখি একদিন কোনো এক দোকানে তোমায়ে নিয়ে গিয়ে বলব, তোমার যতগুলো জামদানি শাড়ি পছন্দ হয় ততগুলো কেন আম্মু। আমার অভিমানী ও প্রবল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বোকা আম্মুটা কি সেদিন নির্লিপ্ত থাকবে? নাকি আমার জন্য ভালোবাসার অশ্রুবিন্দু তোমার চোখে জ্বলজ্বল করবে?
শোনো বোকা মেয়ে নিজের প্রতি আর উদাসীন থেকো না। পাশাপাশি নিজেরও একটু যত্ন নিয়ো। আর আমি কিন্তু এখন ছানার সন্দেশ, মালাই চা আরও অনেক কিছু বানানো শিখে গেছি। তুমি কিন্তু আর মুখ লুকিয়ে কান্না করবে না।

শারমিন মাহবুব: শিক্ষার্থী, হালে, জার্মানি।