মায়ের কাছে লেখা চিঠি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মা, কেমন আছ? দূর পরবাসে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো তোমাকে চিঠি লিখছি। আমার হৃদয়ের অলিগলিতে অসংখ্য অব্যক্ত অক্ষরগুলো প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে তোমার কাছে পৌঁছাবে বলে। কতগুলো বছর পার হয়ে গেল তোমাকে স্পর্শ করি না। তোমার শরীরের মায়াবী সেই ঘ্রাণ পাই না। তোমার আদরমাখা কণ্ঠে ভালোবাসার শব্দ শুনি না!

জানো মা, আমার এই ভিনদেশি পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর! তবু কেন জানি এত সুন্দরের ভিড়ে তোমার মতো অমন সুন্দর মুখ আমি কোথাও খুঁজে পাই না। আমার একলা, নিঃসঙ্গ পৃথিবীটা আরও বেশি ধূসর লাগে তুমি কাছে নেই বলে। তোমার কাছে আমার অনেক অনেক অভিযোগ। কেন জন্মের পর থেকে এত বেশি আদর, ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছিলে? ভাগ্য বিধাতা যখন আমাকে তোমার থেকে যোজন যোজন দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন কেন তোমাকে নির্দয়, পাষণ্ড করে সৃষ্টি করেননি? তাহলে অন্তত, আমার দূর পৃথিবীর কাচের দেয়ালের এপাশে বসে নিষ্প্রাণ আত্মাটা তোমার জন্য ডুকরে কেঁদে মরত না!
আমার সব আছে, শুধু তোমার স্নেহটুকু নেই। আমার এই অতি উন্নত প্রযুক্তির দেশে, এখন আর কেউ প্রতিদিন আমাকে খাইয়ে দেয় না। অথচ তোমার হাতে না খেলে আমার পেট ভরত না। কত বছর তোমার হাতের রান্না খাই না! আমার প্রিয় খাবারগুলো এখন আর কেউ যত্ন করে তুলে রাখে না। অসুখ হলে এখন আর কেউ মাথার কাছে রাত জেগে বসে থাকে না। তোমাকে ঘিরে সব ভালোবাসারা হারিয়েছে স্মৃতির মণিকোঠায়। আমার নির্ঘুম রাত্রিগুলো কাটে অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে! কষ্টে ভেজা বালিশটা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে!
মা কী, মাতৃত্ব কী আমি বুঝেছিলাম সেদিন, যেদিন আমি প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমার অভ্যন্তরে ছোট্ট এক সত্তার উপস্থিতি। আমার সেই নয় মাসের যাত্রাপথে আমি একটু একটু করে তোমাকে আবিষ্কার করেছি। কত কষ্ট আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে একজন মা সন্তানকে বড় করেন, তার সবটুকুই বুঝতে শিখেছি যেদিন প্রথম নিজেও মা হয়েছি। এখন আমি ঠিক তোমার মতো করে আমার সন্তানদের আগলে রাখি। রাতের পর রাত জাগি।
মা, তুমিহীনা আমি আমার বিবর্ণ পৃথিবীতে ভীষণ ক্লান্ত! কত বছর তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না! কত দিন প্রাণখুলে হাসি না, কত দিন চিৎকার করে কাঁদি না! তোমার মতো করে কেউ যে আমায় বোঝে না মা! আমার অভিমানগুলোকে সবাই অভিমান ভাবে। কিন্তু অভিমানের আড়ালে ভালোবাসাটা কেউ বোঝে না। আমার চোখের ভাষা কেবল তুমিই পড়তে পারতে। আমি প্রতিদিনের প্রার্থনায় বিধাতার কাছে কেবল একটা কথাই বলি। আমার সবটুকু আয়ু দিয়ে তিনি যেন তোমায় ভালো রাখেন।
আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার স্বপ্নরা এখন বাড়ি ফেরার জন্য উদ্‌গ্রীব। তোমার কাছে ফেরার আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। আমি ফিরে যেতে চাই আমার সেই স্নেহের নীড়ে, পরম মমতায় মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। সেই দিনটির জন্য সুস্থ দেহে অপেক্ষা করো মা। তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এক জীবনের যাবতীয় অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই মা। বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। অনেক ভালো থেকো। আমার জন্য শুধু এটুকু দোয়া করো, জীবনযুদ্ধে যেন আমি জয়ী হতে পারি। সব বাধা অতিক্রম করার মনোবল যেন আমার থাকে।
ইতি,
তোমার স্নেহধন্য মেয়ে,
স্বাতী।

শাহীন আক্তার স্বাতী: কানাগাওয়া কেন, জাপান।