জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সকালে ঘুম থেকে জেগে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলাম খবরটির দিকে। এবার চট্টগ্রামে বাসে নারী হয়রানি। এ যেন ছোঁয়াচে রোগ। মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাংলাদেশে। অনেক বছরের প্রবাসজীবন হলেও দেশের সঙ্গে খুব নিবিড় সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছি প্রথম থেকেই। ভালো-খারাপ সব খবরেই অনুভূতি হয়। আনন্দিত হই বা কষ্ট পাই, কিন্তু কখনো এসব নিয়ে কলম ধরা হয় না। চেষ্টা করি এখানকার জীবন-ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।

কিন্তু এমন স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে না ভেবে কোনো বিবেকবান মানুষই থাকতে পারেন না, পারছেন না। কেন, কীভাবে, কিসের প্রভাবে ঘটছে এমন কুৎসিত, নৃশংস ঘটনাগুলো?
বেশি না, এক প্রজন্ম আগেও আমরা দেখেছি সমাজ মানুষের কদর করত শিক্ষাকে মানদণ্ড ধরে। অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষগুলো নিয়ম ভেবেই সম্মান করতেন শিক্ষিত মানুষদের! টাকা-কড়িও বেশি থাকত কেবল শিল্পপতি ও সমাজপতিদের হাতেই। সমাজে তিন ধরনের মানুষের বসবাস স্বাভাবিক চোখেই ধরা পড়ত—উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত। তাদের জীবনযাত্রাও চলত এর প্রচলিত নিয়ম মেনে।
তখনকার সময়ের অন্যায়-অপরাধগুলোও হতো যেন একটা সীমার মধ্যে, যেখানে মানুষ অন্যায়ের ধরন বা অপরাধের মাত্রা দেখে অবাক হয়ে যেত না। যারা অপরাধ করতেন তারাও নিজেদের লুকিয়ে রাখতেন সমাজ থেকে, লোকলজ্জার ভয়ে। কারণ তারা স্বীকার করতেন যে খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত তারা।
কিন্তু হঠাৎ করেই যেন শুরু হলো ছন্দপতন। রাতারাতি অপরাধীরা তাদের অপরাধকে ন্যায্য ভাবা শুরু করলেন। শিক্ষিত লোকেদের প্রতি শ্রদ্ধা উধাও হলো নিমেষেই। গুণীজনদের কদর করতে কিপটে হয়ে গেল মানুষ। সমাজের শ্রেণিভেদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে টাকা এখন সবার হাতেই ঘুরে বেড়ায়। কিয়ামতের আগেই সবাই ‘ইয়ানাফসি’ বলার অভ্যাস শুরু করে হয়ে যাচ্ছেন আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর!
একেক সময়ে একেক অপরাধ মহামারি আকার ধারণ করছে। যেন এটা করলে পুরস্কৃত হবে এমনভাবে একজন অন্যজনের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে অপরাধ করছেন।
কেন বাড়ছে এই অপরাধ প্রবণতা?
সমাজ বিশ্লেষকদের দিস্তা দিস্তা রিপোর্ট প্রতিবছর হয়তো ঠিকই বের হয়। যেখানে সমস্যার বয়ান থাকলেও সমাধানের প্যারাটা আসার আগেই রিপোর্ট শেষ হয়ে যায়।
আমরা আমজনতা সাধারণ জীবনবোধ থেকে ঠিকই ধরতে পারি শুভংকরের ফাঁকিটা কোথায়! কিন্তু আমরা যেন চাবি দেওয়া কাঠের পুতুল! আমাদের ভাবনা আর কাজ কেউ চাবি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে।
বাঁকা কথা সোজা করে বললে দাঁড়ায় অপরাধ বৃদ্ধির মোদ্দা কারণগুলো হতে পারে:

শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাওয়া বা শিক্ষার মান না থাকা

বর্তমান সময়ে মানুষ যেহেতু মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে পারছেন না বা করছেন না, তখন তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিচ্ছে। নিজেদের এই দুর্বলতা ঢাকতে তারা শিক্ষিত আর অশিক্ষিত লোকের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলছেন। গুণীজনের কদর করছেন না নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকে।
‘সূর্যের চেয়ে বালুর উত্তাপ বেশি’, এই মূর্খ শিক্ষিতদের কার্যকলাপ, চিন্তা-চেতনা যখন অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিতের মানসিকতার সঙ্গে মিলে যায় তখন তারা সাহসী হয়ে ওঠেন। ভাবেন, আমার চেয়ে বিশেষ তো সে না! তো এত সম্মান করার কী আছে? ব্যাস, সোনা আর আলু-পটলের দাম এক হয়ে যায়!

টাকার সহজলভ্যতা

উন্নয়নের জোয়ার এসে একটা উপকার তো অন্তত হয়েছেই দেশের মানুষের। তা হলো মানুষ অনেক টাকা গুনতে পারেন দিন শেষে। সুপথে বা বিপথে মানুষের আয় বেড়েছে বহু গুন। টাকার মূল্য কমে হয়েছে সবার বিপদের সাথি! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হোক, ব্যবসায়ী হোক বা একজন রিকশাওয়ালা, যার যার প্রয়োজন মেটাতে পারে সহজেই। নিত্য প্রয়োজন মিটিয়েও আজ মানুষ ভিন্ন কোনো চাহিদা বা শখ মেটাতে পারছেন! টাকা যখন শক্তি হয় তখন অপরাধ প্রবণতা বাড়া অস্বাভাবিক কিছু না। অন্যায় করলেও টাকা যে বাঁচিয়ে দেবে এ সমাজ আজ এটা দেখে অভ্যস্ত। আর কতিপয় লোভী, স্কুলবুদ্ধির মানুষ সমাজে তা লালন পালন করে প্রতিষ্ঠিত করছেন। তাহলে অপরাধীদের অভয়ারণ্য কেন হবে না দেশে?

আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ধস

একটা রাষ্ট্রযন্ত্রে যেকোনো অন্যায়ের একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই যথেষ্ট, তার দেশের নাগরিকদের সেই অপকর্ম থেকে দূরে রাখতে! পাশের দেশে মেয়ের শ্লীলতাহানির শাস্তি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করে কয়েক মাসের মধ্যে ফাঁসির রায় দিয়ে কার্যকর করেছিল। তাই এত বড় দেশ সত্ত্বেও এমন অপরাধের মাত্রা আয়ত্তে রাখতে পারছে সহজে।
আর আমাদের দেশে সেই সময়ের খবরে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই অপরাধ শুরু করে আজ তা মহামারি হয়েছে। কারণ একটাই, কান টানলে মাথাটাও যে আসবে! থলের বিড়াল বের করবে এমন বোকা কে? অথচ দুই দশক আগেও এই রাষ্ট্রে ‘অ্যাসিড নিক্ষেপ’ অপরাধ আয়ত্তে এনেছিল আইন পাস ও এর সুষ্ঠু ব্যবহার করেই।

পারিবারিক শিক্ষার অভাব

আদর্শলিপি বইটির কথা মনে আছে আপনাদের? আমাদের ছোটবেলায় পড়তাম। একজন মানুষের জীবনে নৈতিক শিক্ষার জন্য এই একটি বইই যথেষ্ট ছিল! কবে কীভাবে আধুনিকতার রোষানলে পড়ে এই বইটির কবর হলো তা কে জানে। সে যা হোক, আবার পুথিগত বিদ্যা অর্জনের সৌভাগ্য সবার হয় না। কিন্তু বৈষয়িক বিদ্যা অর্জন সম্ভব পরিবার থেকেই। সততা, বিবেকবোধ, মানবিকতা এসব সশিক্ষা সাধারণ পরিবারে যেকোনো বাবা-মা তাদের সন্তানকে দিলেই আর এমন ঘুণে ধরা সমাজ তৈরি হয় না। কিন্তু বাস্তবে এর চর্চা না সরকার দায়িত্ব নিয়ে করে, না পরিবার করে! তাই এই প্রজন্ম বড় হয় অনেকটা আগাছার মতো নৈতিকতা না শিখে। ফলস্বরূপ—ইচ্ছেমতো করো তোমার মনে যাহা লয়।
বিকৃত রুচির মানুষ কিছু থাকেই যুগে যুগে সব দেশে সব সমাজে, তারা অপরাধ করে লুকিয়ে মানুষের সামাজিক অবস্থান বুঝে। আর শাস্তির ভয়ে সেই ভয়াবহতা দেখায়ও কম। কিন্তু এখন পেপার খুললেই দেখছি শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের মেয়েরা জিম্মি এই আধা বা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হাতে, যাদের সম্মান নিয়ে তাকানোর কথা এই মেয়েদের প্রতি। অথচ অবলীলায় প্রতিনিয়ত নারীরা হেনস্তা হচ্ছে বাসে, দোকানে, রাস্তায়। এত সাহস এরা পাচ্ছে কই? সমাজের অবক্ষয় আর কি করলে হয়? কোনো রাষ্ট্র যত দিন একজন নারীর মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত না করবে তত দিন উন্নতির দাবি করতে পারে না। আর যে সমাজ নারীদের সম্মান হেফাজত করে নারীর সম্মান দিতে না পারবে, সে সমাজ সুস্থ সমাজ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে পারে না।

সমাধান?

আপাতত একটাই! রাষ্ট্রের দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে না থেকে ‘জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে!’ চলুন, অপরাধের প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ করি সমাজের সচেতন নাগরিকেরা এক হয়ে। নিপাত যাক বিকৃতমনস্ক মানুষরূপী অমানুষগুলো।

তুলি নুর: ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।