পেছনে পড়ে রয় সেই বাড়িটি

লেখিকা
লেখিকা

অফিস থেকে ফিরে নামাজ আদায় করেই মা বসতেন খাবার টেবিলে। বাবা আর আমরা তিন ভাইবোন অপেক্ষায় থাকতাম। মা মৃদু ভর্ৎসনা করতেন, কেন না খেয়ে অপেক্ষায় থাকি প্রতি দুপুরে। অতঃপর পাঁচ সদস্যের আমাদের পরিবার একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে খেতে হাসিগল্পে মেতে উঠত। অনেক দিন পর্যন্ত এটি একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল।

এভাবে আমরা বেড়ে উঠি। ছোট ভাই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে দিনভর খেলা করে, পড়ায় অমনোযোগী হয়ে ওঠে বিধায় তাকে হোস্টেলে পাঠানো হয়। অফিস থেকে ফেরার পথে মা প্রায়ই তাকে দেখে আসতেন। কখনো ওর মুখটা শুকনো ছিল, কোনো দিন ওর গায়ে স্যারদের মারের দাগ দেখা যেত। আবার কোনো দিন ভালো রান্না হয়েছে, অথচ ও নেই। এসব ভেবে মা প্রায়ই লুকিয়ে অঝোরে কাঁদতেন। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আপাও হোস্টেলে চলে যান। অনেক দিন পরপর ছুটিতে আসেন। উচ্ছ্বসিত মা এটা-সেটা ভালো মন্দ রান্না করেন। বাসায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। একদিন ছুটি শেষে আপা ফিরে যান। ভোর থেকেই মা এটা-সেটা গুছিয়ে দেন। দিতেই থাকেন, যেন পৃথিবী শুদ্ধ দিয়ে দিলেও এ দেওয়া শেষ হওয়ার নয়। আপাকে বিদায় দিয়ে বুকে বালিশ চেপে পাঁজর ভাঙা কান্না মায়ের। কয়েকদিন গুমোট নিস্তব্ধতায় থাকে বাড়িটির আনাচকানাচ।

সবশেষে ইডেনে ভর্তি হয়ে আমিও ছেড়ে যাই আমার শহর। সেই কাকডাকা ভোর থেকেই মা ব্যস্ত। টেবিলে নাশতা সাজান। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। ব্যাগ গুছিয়ে দেন। আমি বলি, এটা লাগবে না, ওটা লাগবে না। তবুও মা দিতে থাকেন। দিতেই থাকেন। বাইরে রিকশা অপেক্ষায় থাকে। পা ছুঁয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরি। মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ আর বুকের উত্তাপ গায়ে মেখে দরজায় পা বাড়াই। রিকশা এগিয়ে চলে। পিছু ফিরে চাই। মা একতলার গেট থেকে উঠে আসে দোতলার বারান্দায়। কোনো এক অদৃশ্য মায়ায়, পিছুটানে ফিরে ফিরে চাই। আরেকটু দেখবেন বলে মা এবার ছাদে এসে দাঁড়ান। দূরে যেতে যেতে আবছা হয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাই। মাকে একটি বিন্দুর মতো মনে হয়। পেছনে পড়ে রয় মায়ের অশ্রুসজল মুখ, বাবার করুন মায়াময় চাহনি আর স্মৃতিময় বাড়িখানা।

মাস শেষে ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে যায়। মা লিখেছেন, ছাদে রজনীগন্ধা ফুটেছে। অথচ কয়েক দিন আগে ফোটেনি বলে, আমি দেখিনি বলে আক্ষেপ চিঠিতে। শূন্য বাড়িটি খাঁ খাঁ করে, সেই হাহাকার চিঠি জুড়ে। মাঝে মাঝে ভাই মারফত টিফিন ক্যারিয়ারে অনেক কিছু রান্না করে পাঠান। ভাবেন, বেশ কয়েক দিন খেতে পারব। ততদিনে হোস্টেলের পাতলা ডাল আর একটুকরো মাছ কিংবা মাংসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আমি সেই খাবার রুমমেটরাসহ ভাগাভাগি করে তৃপ্তি নিয়ে খাই। মায়ের মুখখানা ভেসে ওঠে। দুই চোখ জলে ভেসে যায়। আহা, আমার মায়ের হাতের রান্না!

বড় হয়ে উঠেছি। মায়ের কাছ থেকে মাস শেষে টাকা নিতে সংকোচ বোধ করি। আজিমপুর থেকে মিরপুরে গিয়ে দুটি টিউশনি করি। কেমন করে যেন এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল মায়ের কাছে। চিঠি আসে। পুরো চিঠির মূল কথা, ‘আমি তোমাদের কিসের অভাবে রেখেছি যে, টিউশনি করার প্রয়োজন হলো?’ মাস না ফুরাতেই অনেক ছাত্রীরা যখন বাড়িতে টাকা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠায়, আমি তখন ছুটিতে বাড়ি ফিরে বেঁচে যাওয়া টাকা মায়ের হাতে তুলে দিই। মা খুশি হন না। ভাবেন, ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করিনি কিংবা অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে সীমাহীন কষ্টে থেকেছি হয়তো।

আমরা বড় হই। মায়ের বয়স বাড়ে। বিদেশ থেকে অনেক দিন পরপর দেশে যাই। রাতভর গল্প করি। জমে থাকা যত কথা, সব। শুধু দুঃখের, কষ্টের গল্পগুলো আড়াল করি। কখনো বা মিথ্যে বলি। সব মিথ্যা তো আর ক্ষতিকর নয়! কিছু মিথ্যে কখনো কখনো কারও সুখের কারণ হয়। গল্পের মাঝেই ভোর হয়ে আসে। বাইরে আজান হয়। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। বেলা করে যখন উঠি, ততক্ষণে টেবিলে সব পছন্দের খাবার সাজিয়ে মা অপেক্ষায় থাকেন। সেই ছোটবেলায় কবে কোন খাবারটি পছন্দ করতাম, সেই সব খাবার। আমার প্যারালাইজড বাবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাজারে গিয়ে দুর্লভ সেই সব পছন্দের আইটেমগুলো কিনে নিয়ে এসেছেন!

অতঃপর ২০১২ সালে সেই বাড়িটিতে যখন যাই, তীব্র এক ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিকম্প হয় বুকের বাঁ পাশে। অশান্ত অস্থির চোখ জোড়া খুঁজে বেড়ায় বাড়ির আনাচকানাচ। আমায় ভালো রাখবে বলে, ভালো খাওয়াবে বলে ব্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ দুজন নেই! নেই মানে নেই! পৃথিবীর কোথাও নেই। নির্ঘুম দুঃসহ দুই রাতের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি, আমি ফিরে আসি। অন্যরকম এক ফেরা। দুই পা ছুঁয়ে সালাম না করে ফেরা, মায়ের বুকের উত্তাপ না নিয়ে ফেরা, জড়িয়ে ধরে গায়ের মিষ্টি গন্ধ শুঁকে বিদায় না নিয়ে ফেরা। বুক চিরে আসা দীর্ঘশ্বাসে পিছু ফিরে চাই বারে বারে। একতলার গেট, দোতলার বেলকনি, সবশেষে ছাদের কোণা। সবই আছে আগের মতোই। সেই বেলকনি, সেই ছাদ। ছিল না তবুও কিছুই। বুকের বাম পাশে ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি। চোখের উষ্ণ জল টপটপ করে ঝরে রিকশায় ছিটকে পড়ে। রিকশা এগোয়। এগোতে থাকে, সামনে, দূরে, আরও দূরে। পেছনে ঝাপসা হয়ে পড়ে রয় সেই বাড়িটি, যেখানে একদা পাঁচ সদস্যের একটি সুখী পরিবারের গল্প ছিল। মা দিবসে পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের জন্য ভালোবাসা অন্তরের অন্তস্তল থেকে।

রিমি রুম্মান: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।