গোল্ডকোস্টে বৈশাখের আনন্দ ধারা
‘আনন্দেরই সাগর থেকে/ এসেছে আজ বান।/ দাঁড় ধরে আজ বোস রে সবাই,/ টান রে সবাই টান।’
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের গোলকোস্টে সেদিনের সেই সন্ধ্যাবেলাটা কিঞ্চিৎ তেমনই ছিল। পুব আকাশে লাল সূর্য উদিত হলে বেজে ওঠে ঢোল বাদ্য আর মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ বরণ। বিদেশবিভুঁইয়ে তা অবাস্তব হলেও অসম্ভব নয়।
কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান ভানে! আমরা বাঙালিরাও ঠিক তেমন। হাজার কাজেও উৎসব আয়োজনে জুরি মেলা ভার। তাই দুই মাসের মহড়া আর তোড়জোড়কে উৎসবে রূপ দিতে বাংলাদেশ সোসাইটি গোল্ডকোস্ট গত ২১ এপ্রিল শনিবার আয়োজন করেছিল বৈশাখী উৎসব।
উৎসবের সেই সন্ধ্যায় যথাসময় সকলে বৈশাখী সাজে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে নৌকারূপী আয়োজনের হাল ধরে বসলেন। উদ্দেশ্য আর গন্তব্য একটাই, আর তা ছিল আনন্দ!
গোল্ডকোস্টের হেলেন্সভেল কালচারাল সেন্টারে আয়োজন করা হয় ১৪২৫ বৈশাখী উৎসব। এটি গোল্ডকোস্টের অন্যতম ও অত্যাধুনিক সাংস্কৃতিক মিলনায়তন। যেখানে রয়েছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম আর আলোকসজ্জার ব্যবস্থা।
আয়োজক দল বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র আর সরঞ্জামাদি নিয়ে যখন হাজির হলো তখন বিকেল ৪টা। উদ্দেশ্য একটাই, যথাসময়ে একটি সুন্দর আয়োজন মঞ্চে উপস্থাপনা। একদিকে যখন যন্ত্রীদল তাদের বাদ্যযন্ত্রকে সুরেলা করতে শব্দ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত ঠিক তার অন্যদিকেই চলেছে বৈশাখী স্টল সাজানো। কী নেই তাতে! হরেক রকমের কাপড়, প্রসাধন আর অলংকার থেকে শুরু করে চটপটি, ফুচকা, বিরিয়ানি আরও নানাপদের খাবার।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সংগঠনের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এর পরই শুরু হলো সাংস্কৃতিক সম্পাদকের নেতৃত্বে অনুষ্ঠান। প্রথমেই সেতার আর বাঁশির সূরের মূর্ছনা। ততক্ষণে দর্শকসারি পরিপূর্ণ। অনুষ্ঠান সঞ্চালকের ভূমিকায় নাজমুন আক্তার মুন বরাবরের মতো আবারও তাঁর পারদর্শিতা প্রমাণ করলেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ছাড়া এ পথ যে মসৃণভাবে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয় দর্শক তা আরেকবার বুঝলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ছিল শিশুদের নৃত্য পর্ব।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের চিরায়ত গান—এসো হে বৈশাখের সূরের মূর্ছনায় পরিবেশিত হলো একটি দলীয় নৃত্য। এরপর একে একে লাল টুকটুকে বউ, ধিতাং ধিতাং বলে আর আইল আইল রঙ্গে ভরা বৈশাখের তালে শিশুরা নেচে উঠল। তাদের নাচের উন্মাদনা আর দর্শকের করতালিতে একটি বারের জন্যও মনে হয়নি এই ছোট শিশুরা বাংলাদেশের রূপ-রস আর গন্ধে বেড়ে ওঠেনি।
শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের-মামার বাড়ি কবিতাটি আবৃত্তি করে সবার মন জয় করে তুবা। আধুনিক গান ধিম তানার সঙ্গে পরিবেশিত হলো একটি একক নৃত্য। পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা ও একটি বাংলাদেশ গান দুটি সম্পূর্ণ বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে এককভাবে পরিবেশন করল-ঈদ ও রুফাইদা। রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন সুচরিতা কর্মকার সঙ্গে তাঁর মেয়ে রিশীতার নাচ, পঞ্চইন্দ্রিয়কে এক অদ্ভুত দোলা দিয়ে গেল যেন।
রাত ৮টায় অনুষ্ঠানস্থল লোকে লোকারণ্য। এ সময় শুরু হয় অতিথি শিল্পীদের গানের পর্ব। সুদূর সিডনি থেকে আগত নজরুলসংগীতশিল্পী অমিয়া মতিন আর কুইন্সল্যান্ডের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচরিতা কর্মকার তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়।
যন্ত্রের তালে তালে শিল্পীরা তাদের নিজস্ব ঘরানার বাইরেও আধুনিক ও লোক গান করে সকলের মন মাতালেন। যন্ত্রীদল ততক্ষণে সুর সাধায় মগ্ন। দর্শক সারিতেও একই ব্যাকুলতা।
পপগুরু আজম খানের গান নিয়ে আসেন আরেকজন অতিথি শিল্পী সাব্বির মুজিব। আজম খানের জনপ্রিয় সব গান আর সাব্বির মুজিবের অসাধারণ পরিবেশনায় দর্শকসারি নেচে উঠল, কেউ কেউ ততক্ষণে মঞ্চে উপবিষ্ট!
গানের অনুকরণে বাদ্যযন্ত্রের যে ভূমিকা তাকে যথাযথ সম্মান ও আয়োজকদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানিয়ে গান পর্ব শেষ করেন গুণী শিল্পীরা। সংগঠনের সভাপতি ডা. জাফর হোসেন শিল্পীদের ফুল ও স্মারক দিয়ে ধন্যবাদ জানান। বিশেষভাবে ফুল দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানান প্রকৌশলী মামুন চৌধুরীকে তার অসাধারণ শব্দ ও আলোকসজ্জা নিয়ন্ত্রণের জন্য।
যন্ত্রশিল্পীদের মাঝে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন সংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সাইফ শরীফ। সংগীত আয়োজন, কিবোর্ড বাজানো ও সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানকে নিরবচ্ছিন্নভাবে মঞ্চস্থ করায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনবদ্য। কোনোরকম অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতি ছাড়াই পুরো অনুষ্ঠান শেষ অবদি দর্শক মহলে যে তৃপ্তি ছড়িয়েছে তা সত্যিই বিরল। সেই তৃপ্তির জায়গা থেকে আয়োজক ও দর্শক সকলেই তার প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। অন্যান্য যন্ত্রীদের মাঝে গিটারে ছিলেন মিকো ও ড্রামসে ছিলাম আমি ইশরা।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব সাজানো হয়েছিল নাটক, ফ্যাশন শো, বৈশাখী ডকুমেন্টারি, কুইজ আর ছোটদের বৈশাখী মেলা দিয়ে। এত অল্প সময়ে মহড়া দিয়েও যে এত দক্ষতার সঙ্গে নাটক মঞ্চস্থ করা যায় তা বিস্ময় বটে!
বাংলা নববর্ষের সূচনা, ইতিহাস ও এর বিবর্তন অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে আর একবার প্রশংসিত হলেন সাইফ শরীফ। কুইজ পর্বে প্রবাসে বেড়ে ওঠা আমাদের এই ছেলেমেয়েরা বাংলা লোকগীতির ভাবার্থ অনুবাদ করে উপস্থিত সকলের মন জয় করে। ছোট শিশুদের বৈশাখী মেলায় ছিল চুড়িওয়ালা, ফুলওয়ালা, বেদেনি, বায়োস্কোপ, বাউল, ঢোল আরও কত কী আয়োজন। তাদের এই প্রাণোচ্ছল মেলার আয়োজনে মায়েদের ভূমিকা তুলনাহীন। এই মায়েরা যারা সকল শক্তির উৎস, যেকোনো সফলতার এক নীরব কারিগর। ধন্যি মা, ধন্যি বাঙালি, ধন্যি বাংলাদেশ!
বৈশাখী স্টল ও খাবারের আয়োজন অনুষ্ঠানের থিয়েটার থেকে একটু আলাদা স্থানে হওয়ায় সমগ্র আয়োজন এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল আর দর্শক মনভরে তা উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানের মহড়া থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের দিন পর্যন্ত অন্তরালে থেকে রসনা বিলাসের সার্বিক দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনায় যিনি নিয়োজিত থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের দুই মাসব্যাপী বৈশাখী উৎসবকে সফল হতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তিনি সংগঠনের সহসভাপতি খাদিজা খানম।
সবশেষে ফ্যাশন শোর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি হয়। ঘড়ির কাঁটা তখন ১০টা বেজে ৩০ মিনিট। সুন্দর ও সফল একটি দিনের পরিসমাপ্তি। এক সাগর আনন্দের বানে ভেসে আমাদের সকলের মন তাই গেয়ে উঠেছিল—আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে...।
রাকিয়া হোসাইন: গোল্ডকোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।