মা-বাবার জন্য কোনো দিবস লাগে না

মায়ের সঙ্গে লেখক
মায়ের সঙ্গে লেখক

মায়ের সঙ্গে দূরত্বটা হঠাৎ করে হয়নি। প্রথম দূরত্ব তৈরি করেছিলাম একটি বেসরকারি চাকরির সুবাদে। দূরত্ব ছিল মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার। কুষ্টিয়ার চৌড়হাস মোড় থেকে ঈশ্বরদী। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। সপ্তাহান্তে বাবা-মাকে একবার করে দেখতে যেতাম। দু-এক দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে আবারও অফিসে ফিরে আসতাম। মাঝে মধ্যে না বলে হঠাৎ করেই বাসায় উপস্থিত হতাম। অফিসেই ফোনে কথা হতো। দুঃখ-দুঃখ মুখ করে বলতাম এ সপ্তাহে আসতে পারব না। মা খুব অভিমান করতেন। পরমুহূর্তেই হঠাৎ বাড়িতে গিয়ে মাকে চমকে দিতাম। বয়সের ভারে দুর্বল আব্বা তার হাতের লাঠি ফেলে জড়িয়ে নিতেন শক্ত বুকে।

আমার আব্বার পানের পিক লাগানো তিলে পড়া দোমড়ানো মোচড়ানো জামার সেই বিশেষ গন্ধ এখনো মাঝে মাঝে অনুভব করি। আক্ষরিকভাবে অনুভূতির ব্যাপারটা অবাস্তব মনে হলেও এটা হয়তো বাস্তব, প্রতিটি সন্তানই বাবা-মায়ের শরীরের একটা অদ্ভুত গন্ধ অনুভব করে। ব্যাপারটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। যাতে করে সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ের কথা আমৃত্যু মনে রাখতে পারে। অদ্ভুত ব্যাপার, পৃথিবীতে এই গন্ধের কোনো অস্তিত্ব অন্য কোথাও মেলে না। আব্বার বুক থেকে ছাড়া পেয়ে মায়ের মুখের প্রশস্ত হাসিটা একপলক উপভোগ করতাম। আমার বাবা-মা আবার একটু বোকা টাইপের। হয়তো জগতের সকল বাবা-মাই সন্তানের কাছে সহজ-সরল হন। সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখলে আমিও কোনো দিন বোকা বাবা হব। এটাই হয়তো জগতের নিয়ম। বাবা-মাকে বোকাই হতে হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে এই চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্ব তৈরি করতে গিয়েই বুঝতে পেরেছি কতটা ক্ষত তৈরি করতে পারে মায়ের কান্না আর বাবার হাহাকার।

আসছে তেরোই মে বিশ্ব মা দিবস। নিজের জীবন থেকেই শিখেছি। আসলে বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্য কোনো বিশেষ দিবস লাগে না। প্রাণের স্পন্দন যেমন বলে কয়ে হয় না। টিক-টিক করে আজীবন চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। তেমনি বাবা-মাকে ভালোবাসার জন্য অনুষ্ঠান করে দিবস পালন হয় না। তবুও ব্যস্ত জীবনে বছরের একটি দিন শুধুই বাবা-মাকে উৎসর্গ করা! খানিকটা স্মৃতিকাতরতা ও অবাধ্য চোখের প্রবহমান পানি৷

ছোটবেলায় মা যখন শাসন করতেন, একটা কথা সব সময় বলতেন। যখন থাকব না তখন বুঝবি যে মা কী ছিল! একই কথা আব্বাও বলতেন। বাজানরে যেইদিন থাকব না সেই দিন বুঝবা! কথায় আছে, দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্ম বোঝে না। দাঁত একবার চলে গেলে সোনার দাঁত বাঁধিয়েও প্রকৃত শান্তি মেলে না৷ অবশ্য এখন আমি সব দাঁতের মর্মই বুঝতে পারি। মা আজ পৃথিবীতে থেকেও কাছে নেই। আব্বাকে হারিয়েছি গত বছরের মাঝামাঝি সময়টাতে৷

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। হাত–পা অসাড় হয়ে আসে যখন শুধু এতটুকু ভাবি। এই পৃথিবীতে আব্বাকে আর চোখের সামনে দেখতে পাব না। হাতের লাঠি ফেলে আমাকে বুকে নেবেন না। আমার গল্প মানুষের কাছে করবেন না। মাও আর আগের মতো চঞ্চল নেই। মা আমার ডায়বেটিস রোগের সুবাদে পৃথিবীতে যত রকমের অসুখ আছে সব প্রায় একাই দখল করে বসে আছেন। আমার মায়ের সাদা প্রেসক্রিপশনের সাদা জায়গা খালি থাকে না। পুরোটা জুড়েই থাকে ওষুধের ফর্দ। মায়ের ওষুধ কিনতে দোকানে গেলে ফার্মেসির দোকানদার ভাবতেন আমি নিজেই ছোটখাটো একটা ফার্মেসি চালাই। মাঝে মা একবার ব্রেইন স্ট্রোক করে কোনো রকমে ফিরে এসেছেন।

গবেষণার প্রতি আমার প্রবল ঝোঁক ছিল৷ সাধারণ কোনো চাকরি করার ইচ্ছা কোনো কালেই ছিল না। উদ্ভাবনী কোনো কাজ করতে খুব আগ্রহী ছিলাম। এমএসসি শেষ করে দেশে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছিলাম না। অবশেষে দেশের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্বটাও চোখের পলকে চল্লিশ থেকে আট হাজার চল্লিশ কিলোমিটার হয়ে গেল। এখন আর মন চাইলেও মাকে চমকে দিতে পারি না।

গত বছরের প্রথম দিকে দেশে ফিরে বাবা-মাকে দেখে আসার কয়েক দিনের মাথায় আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষদের সমস্যা হচ্ছে বাবা-মায়ের কোনো খারাপ খবর শুনেই প্লেনে চেপে বসতে পারি না। আমাদের অনেক হিসাব মেলাতে হয়। এটা শুধু আমার ব্যথা নয়, সকল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত প্রবাসী সন্তানের ব্যথা। পৃথিবীতে বাবা-মায়ের শেষ নিশ্বাসের সময় পাশে থাকা কপালে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত প্রবাসী সন্তানের খুব একটা জোটে না। আব্বার জানাজায় সরাসরি থাকতে পারিনি। বড় ভাইয়ের ফোনে ভিডিও কলে দেখেছিলাম। সহ্য না করতে পেরে ফোন কেটে দিয়ে শুধুই কেঁদেছিলাম। এ বছরের শুরুতে মাকে দেখে এসেছি। আব্বার ঘরে জানালার চৌকাঠে পানের পিকে ভিজে থাকা লাল রংটা এখনো ফ্যাকাশে লাল হয়ে আছে। ঘষে তুলে ফেলার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। পুরোটা তোলা যায়নি। আলনা থেকে আব্বার জামা-কাপড় সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বুক শেলফের কোরআন শরিফ ও হাদিসের বইগুলোতে ধুলো জমে গেছে। আব্বার ব্যবহৃত অক্সিজেনের খালি সিলিন্ডার ঘরের এক কোণে জায়গা দখল করে আছে। আব্বার রেখে যাওয়া লাঠি এখন মায়ের সম্বল।

মায়ের সঙ্গে দূরত্ব এখন পাঁচ হাজার মাইল এবং আব্বার সঙ্গে দূরত্বের পরিধি আমার আজও অজানা। তবুও জীবন তার নিয়মেই চলছে। অন্য সবার যেভাবে চলে ঠিক সেভাবেই চলছে। পরবাসে ব্যস্ত থাকি ছোট্ট এক পরিবার নিয়ে। আমি ও আমার সহধর্মিণী। সারা দিন অফিস করে শেষ বেলাতে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। সর্বনাশা ডায়াবেটিস আমার মায়ের চোখ, কিডনি, পিত্ত, হৃদয় অদৃশ্য শকুনের মতো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। অসহায় মায়ের অসুখের কাছে আত্মসমর্পণ করা মুখখানা দেখলেই বুঝতে পারি তার শরীরের ভেতরে কী বিশ্বযুদ্ধ চলছে! আমিও অসহায়। মায়ের প্রতি ভালোবাসা নিজের ভেতরে চাপিয়ে রাখি৷ মাকে কখনো বলা হয় না। মাকে অনেক ভালোবাসি।

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।