আমার মা ও শাশুড়ি মা

লেখিকার মা ও শাশুড়ি মা
লেখিকার মা ও শাশুড়ি মা

আমার শাশুড়ি মা অসুস্থ। তীব্র এক যাতনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। কিছু করতে না পারার যাতনা। দেশ ছেড়ে বিদেশ থাকার এই এক জ্বালা। অসুস্থ বাবা-মার মুখটা কল্পনা করা ছাড়া, ধরা ছোঁয়ার উপায় নেই। নিয়ম করে ফোন দিয়ে সান্ত্বনা বাক্য আর কিছু উপদেশ দেওয়া। এই যা। এতে সাময়িক স্বস্তি পেলেও সমাধান কী কিছু মেলে, মেলে না। উপরন্তু, কাউকে দায়িত্ব দিতেও কুণ্ঠাবোধ হয়। মনে হয় এই বুঝি তারা ভাববেন, নিজে তো নেই তাই অন্যের ওপর দায়িত্ব চাপানো হচ্ছে। আমার এই যাতনা দেখে নিজের কাছেই নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হই—‘মায়ের চেয়ে কি মাসির দরদ বেশি’।

আচ্ছা, আদৌ কি আমি মাসি? কই আমার মা আর শাশুড়ি মা দুজনের জন্যই তো আমার সমান খারাপ লাগে। তবে আমি মাসি হতে যাব কেন? আমার মা যেমন আমাকে নিয়ে ভাবেন মাও (শাশুড়ি) ঠিক তেমন করেই ভাবেন। আমার কষ্টে দুই মা-ই যেমন সমান কষ্ট পান ঠিক তেমনি আমার আনন্দে হন আনন্দিত। আমিতো আমার প্রতি, মা ও শাশুড়ি মায়ের ভালোবাসায় কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। তাহলে মার জন্য আমার এই যাতনা অনুভব হওয়ারই তো কথা।
একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট বোঝা যাবে শাশুড়ি মা আমাকে কতটা ভালোবাসেন। ছোটবেলা থেকেই সুচ, কাঁচি, ছুরি, ইনজেকশন এসবে ছিল আমার ভীষণ ভয়। এসবের ভয়েই বিয়ের চার বছর পর আমি মা হয়েছি। মা হওয়া তো নয়, যেন আলী বাবার চল্লিশ চোরের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের গল্প। আমাকে ওটিতে নেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমার গর্ভধারিণী মা ভয়, কষ্ট ও শোকাবহ হয়ে আমার সামনে না এসে দোয়া দরুদ পড়ায় ব্যস্ত হয়ে চোখের অন্তরালে কোথাও লুকিয়েছিলেন। আমাকে যখন অপারেশন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আমার শাশুড়ি মা আমায় অনেক আদর করে, গাল মুখ নেড়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন। দূর থেকে আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তার পলকহীন চোখ বেয়ে, গাল গড়িয়ে কয়েক ফোটা পানিও নাকি পড়েছিল। আর তিনি নাকি এও বলেছিলেন—‘আমার লাভলী এত ভিতু, আল্লাহ তুমি ওকে সাহস দিয়ো।’
কথাগুলো আমি সুস্থ হওয়ার পর আমার মায়ের মুখে শুনেছিলাম। এটা শোনার পর এক অজানা ভালো লাগা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। তবে আমার দুই মায়ের আমাকে নিয়ে ভয়ের কারণ যে অমূলক ছিল না, তা ডাবল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়াতেই বোঝা গিয়েছিল। ডাক্তারেরা পর্যন্ত বলেছিলেন, এমন ভিতু তারা জীবনে দেখেননি। অবশেষে ভয় সমুদ্র জয় করে সদ্য মা হওয়ার আনন্দে গর্বিত জননী হিসেবে বিজয়ের হাসি হেসে ওটি নামক ভয়ংকর সেই কক্ষ থেকে আমি বের হলাম। তখন কিন্তু আমার দুই মা-ই দুপাশে ছিলেন, আবেগ, আদর ও আহ্লাদে আমাকে আহ্লাদিত করার জন্য। মেয়ের বাবা দেশে না থাকার শূন্যতা আমি একটুও অনুভব করিনি এই প্রিয় মুখগুলোর জন্য।
আর একটা আশ্চর্যের বিষয় না বললেই নয়। আমার মায়ের মাথায় হঠাৎ কী ঢুকল কে জানে, আমার মেয়ে হওয়ার দিন থেকে আজ অবধি আমার মা, আমার শাশুড়ি মাকে দাদিজান আর শ্বশুর আব্বাকে দাদাজান বলে ডাকে। অনেকটা অলিখিত ভাবেই মা তাদের বড় নাতনি আর আমার মেয়ে তাদের ছোট নাতনি হয়ে গেছেন। মানুষ মেয়ে বিয়ে দিয়ে পায় বেয়াই-বেয়ান, আর আমার মা পেল দাদা-দাদি। এও কি কখনো হয়ে থাকে, আমার জানা ছিল না।

মা ও শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে লেখিকা
মা ও শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে লেখিকা

শুনেছি, বিয়ের আগে প্রতিটা মেয়েরই কিছুটা হলেও শাশুড়ি ভীতি থাকে। আমারও ছিল। তবে সে ভীতি আমার এই বিবাহিত জীবনের দশ বছরে একটি বারের জন্যও আমাকে স্পর্শ করেনি। বরং বিয়ের পর প্রথমবার বাসায় যাওয়ার সময় আমি না করা সত্ত্বেও আমার শাশুড়ি মা নিজে হাতে আমাকে হাঁড়িপাতিল, কাঁথা-কম্বল পাটে পাটে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মা এসব দেখে কতটুকু খুশি হয়েছিলেন, সেদিন তার একটা কথাতেই বুঝেছিলাম—‘তোমার শাশুড়ির মতো আমিও এমন সুন্দর করে গুছিয়ে দিতে পারতাম না।’ অথচ, আমার মা যে বাক্স-প্যাঁটরা করায় কতটা পারদর্শী তা আমি রোকেয়া হলে থাকাকালে বাড়ির আশপাশের সবাই দেখেছেন। আমি হলে যাওয়ার তিন দিন আগে থেকে তিনি রান্না শুরু করতেন, আমি যেন সবাইকে নিয়ে খেতে পারি।
ঠিক মার মতো, আমাকে নিয়ে আমার শাশুড়ি মায়ের চিন্তা ভাবনা ও ভালোবাসাও লিখে শেষ করার মতো নয়। আমার মা ছিলেন আমার সেরা বন্ধু। আমার এমন কোনো কথা নেই যা মা জানতেন না। ঠিক মায়ের মতো সেরা বন্ধু আমার শাশুড়ি হতে পারবেন কিনা এমন ভাবনার সময় না দিয়েই বিয়ের প্রথম রাতে মা আমাকে অশ্রুসজল দেখে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—‘মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে, আমি আছিতো’। তারপর আর কোনো দিন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মাকে ভাবার অবকাশ পাইনি।
এ নিয়ে আমার বাবা-মা, দুই বোনের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকদেরও অভিযোগের শেষ ছিল না। শ্বশুরবাড়ি গেলে আমি নাকি বাড়ির সবাইকে ভুলে যাই। আমার কী দোষ। আমি কী আর ইচ্ছে করে ভুলে যেতাম। সেখানে আমার বিশাল বাহিনী নিয়ে হইহুল্লোড়, নৌকাভ্রমণ, ভ্যান ভ্রমণ, মেঠো পথের পদযাত্রা, চাচি শাশুড়ির বাড়ি, ফুপু শাশুড়ির বাড়ি, এ বাড়ি সে বাড়ি করেই দমকা হাওয়ার বেগে কেটে যেত টানা কয়েকটা দিন। সেইসঙ্গে এক এক বার গিয়ে বাহারি রকমের রান্না করে খাওয়ানো তো ছিলই। এর মধ্যে সময় করে সময় বেধে খোঁজ নেওয়ার অবসর কোথায় আমার? এহেন অপরাধে আমার বিরুদ্ধে ছিল দুই বোনের রাজ্যের নালিশ। মজার ব্যাপার হলো, ওরাও যতবার এ বাড়িতে এসেছে, আনন্দ-আড্ডায় এতটাই মশগুল থেকেছে যে, মাথা নত করে স্বীকার করেছে, ফোন দিয়ে ওদের খোঁজ খবর না নেওয়াটা যথার্থই যুক্তিসংগত, দোষের কিছু নয়।
আমার মনে আছে, বিয়ের আগেই আমার মা আমার শাশুড়ি মায়ের কাছে শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, আমার যেহেতু ছেলে নেই তাই আমার মেয়ে এক ঈদ আপনার সঙ্গে আর এক ঈদ আমার সঙ্গে করবে। আমার শাশুড়ি সেদিন বিনা বাক্যে রাজি হয়েছিলেন। তিনি হয়তো বুঝেই নিয়েছিলেন, তার বাড়ির ঈদ আনন্দ ফেলে লাভলী কখনো যেতে পারবে না। সত্যিকার অর্থে শ্বশুরবাড়ির ঈদ ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছা করেনি। তা ছাড়া ঈদ আনন্দ বলতে কী আর ঈদের এক দিনের আনন্দ। আগে পরের দিন মিলিয়ে পাঁচ দিন।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার আগেই মা সুন্দর পরিপাটি করে আমাদের সবার জন্য ঘর গুছিয়ে রাখতেন। যেহেতু সব ছেলেরা পরিবার পরিজন নিয়ে একসঙ্গে থাকে না, তাই ঘর বরাদ্দের ক্ষেত্রেও পাওয়া যেত মার বিচক্ষণতার ছাপ। এ ছাড়া, ঈদের দুদিন আগে আমাদের সবার মাথায় ঘটা করে মেহেদি দেওয়া ছিল মার রেগুলার রুটিন। আর ঈদের দিন মাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে দেওয়া ছিল আমার রুটিন।
এত কিছুর মাঝেও আমাদের বাড়ি থেকে একটু পরপর ফোন। আমার ফোন বাজলেই মা বলতেন, লাভলীর মার সময় কাটছে না। ওদিকে আমার মা আমাকে ফোন দিয়ে বারবার মনে করিয়ে দিতেন, আমি এখানে যা যা করছি বাড়ি গিয়ে যেন তাই তাই করি। আচ্ছা, একসঙ্গে দুই মায়ের মন রক্ষা করার কি কোনো সূত্র আছে, থাকলে আমি তাই করতাম। মা বনাম শাশুড়ি মায়ের কতশত দুঃখগাঁথা শুনেছি জীবনে, অথচ আমার জীবনটা দুই মায়ের ভালোবাসায় কানায় কানায় ভরপুর। এই ভালোবাসাময় জীবনটা অর্থহীন মনে হয়, যখন শুনি দুই মায়ের একজন অসুস্থ। পরম করুণাময়ের কাছে তাই একটাই প্রার্থনা, আমার শাশুড়ি মাকে অসুস্থতার আঁধার পেরিয়ে তিনি যেন আলোতে নিয়ে আসেন। আমিন।

লাভলী ইয়াসমীন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।