এ কেমন আন্দোলন!

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

ফ্রান্সে আসার আগেই দুটি ফ্রেঞ্চ শিখে ফেলেছিলাম। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর ফ্রেঞ্চ কিস! ফ্রান্সে আছি দুই বছরের মতো হলো। এখন তো অনেক কিছুই শিখেছি, শিখছি। তবে এদের আন্দোলনটা নতুন শিখলাম। এ কেমন আন্দোলন! দেড়-দুই লাখ মানুষের লম্বা মিছিল। ‘জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’—এর স্লোগান নেই। কাঁদানে গ্যাস নেই। জলকামান নেই। লাঠিপেটা নেই!

গত শনিবারের (৫ মে) অভিজ্ঞতাটা বলি। সকালে বেরিয়েছি কাজের উদ্দেশে। গন্তব্য সাতলে লে হাল। লে হালে যাওয়ার পথেই বেহাল দশা হলো। মাঝপথে গিয়ে বিপত্তি। যে মেট্রোতেই উঠি, মাঝপথে নামিয়ে দেয়! শেষে এটিয়েন মার্শেল নেমে ঠ্যাং-মেট্রোই ভরসা। মানে পায়ে হেঁটে আর কি। হাঁটাপথেই দেখলাম, পুলিশের গাড়ি আর গাড়ি।

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

কিছু রাস্তা বন্ধ করা আর পুলিশ রাস্তায় মুখে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু এগোতেই দেখলাম অনেক মানুষের ভিড়। মিছিল করছেন মানুষ। মানুষ আর মানুষ। আমার কাজের জায়গা থেকে প্রায় ৭৫ মিটার দূরে। কিন্তু সময় না থাকার কারণে ওদিকে আর গেলাম না। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম কাজের বিরতিতে একবার গিয়ে দেখে আসব।
কাজ শেষ করে বের হলাম দুপুর তিনটার দিকে। বড় রাস্তার দিকে রওনা দিলাম। গিয়েই একটা বড় ধাক্কা খেলাম। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। এ যেন মানুষের মহাসমুদ্র। আমার এই ছোট জীবনে এত মানুষ একসঙ্গে দেখিনি। সবার হাতে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানার। মাথায় হরেক রকমের টুপি, মুখে মুখে স্লোগান। কেউ কেউ নেচে নেচে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন, কেউ ভাষণ দিচ্ছেন, অনেকের হাতে ফ্রান্সের পতাকা।

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

নিজেদের দাবি আদায়ের আন্দোলন করছেন সবাই। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, বাবার কাঁধে ছোট শিশু, মাথায় ধবধবে সাদা চুল নিয়ে ৬০-৭০ বছর বয়সের বুড়ো-বুড়ি, যুবক-তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীসহ অনেকে। এক নারীকে দেখলাম ছোট বাচ্চাকে বুকে বেঁধে নিয়ে আন্দোলনে এসেছেন। আন্দোলনে নাচ-গান আছে। স্লোগান আছে। উত্তেজনা রোমাঞ্চ সবই আছে। কিন্তু কেউ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন না!
আবার নিরাপত্তা বাহিনীও যুদ্ধংদেহী চেহারায় নেই। আন্দোলন দমনের জন্য সরকার পেশিশক্তি ব্যবহার করছে না। লাঠিপেটা হচ্ছে না। টিয়ারশেল নিক্ষেপ হচ্ছে না। কোনো ধরপাকড় নেই। গ্রেপ্তার নেই। জলকামান নিক্ষেপ নেই।

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

আগ্রহ বাড়তেই এরপর থেকে প্রায় খোঁজ রেখেছি এই আন্দোলনের। আন্দোলনটা মূলত করছে ফ্রান্সের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংগঠনটি। তারা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ছাত্র, রেলকর্মী, সাধারণ কর্মী, কমিউনিস্ট পার্টিসহ আরও অনেকে। এই আন্দোলন হচ্ছে ম্যাঁখো সরকার সরকারি খাতে ব্যাপক পরিবর্তন ও সংশোধনের ঘোষণা দেওয়ায়। এর মধ্যে রেলকর্মী ছাঁটাই, কাজের চুক্তির ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে পরিবর্তন, রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ক্ষেত্রে সময় কমানো, ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিবর্তন, ধনীদের কর কমানো...নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারীরা বলছে ম্যাঁখো সরকার বড়লোকদের সরকার। এতে ধনীরা আরও ধনী হবে। গরিব গরিবই থাকবে।

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

এদের ধর্মঘটের আন্দোলনটাও একটু অন্য ধরনের। প্যারিসে যোগাযোগ ব্যবস্থা মেট্রো-নির্ভর। আন্দোলনের বড় অংশীদার যেহেতু রেলকর্মীরা, তাঁরা ধর্মঘট করছেন। কিন্তু তার মানে রেল বিভাগ পুরো বন্ধ নেই। সাধারণ মানুষদের তাঁরা একেবারেই জিম্মি করে দাবি আদায় করতে চান না। ফ্রান্সে এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘট জুন পর্যন্ত চলবে। তবে ধর্মঘট হচ্ছে সপ্তাহে দুই দিনের জন্য। ওই দুই দিন রেলে ধর্মঘট।
সেটিও আবার পুরো ধর্মঘট নয়। যেখানে ঘণ্টায় পাঁচটা ট্রেন চলার কথা সেখানে ঘণ্টায় দুটি ট্রেন চলছে। আবার সেগুলো পুরো গন্তব্যেও যায় না। একটা ট্রেন ১০টা স্টপেজে গেলে, আরেকটা যায় পরের ১০টায়। তাতে যাত্রীদের অবশ্যই অসুবিধা হচ্ছে। কারণ এই দেশ সম্পূর্ণ রেল-যোগাযোগ নির্ভর। যেমন সাধারণ দিনে কাজে যেতে ২৫ মিনিট লাগে। ধর্মঘটের দিনে লাগে এক ঘণ্টা। কষ্ট একটু হয়, তবে যাত্রীদের একেবারেই অচল করে দেওয়া নয়। আর সপ্তাহে দুদিনের জন্য, এও মেনে নিচ্ছেন অনেকে।

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

এভাবে চলছে আন্দোলন। মাঝে আন্দোলনে উত্তেজনা ভর করেছিল। ১ মে শ্রমিক দিবসে। সেদিন দাঙ্গা পুলিশও সক্রিয় হয়েছিল। দুই শ জনের মতো গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে অনেকেরই দাবি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটার মধ্যে সুযোগসন্ধানী কেউ ঢুকে পড়েছিল। কারণ এই আন্দোলন শুরু থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে চলবে, দাবিদাওয়া আদায় না পর্যন্ত। এমনটাই নাকি দিক নির্দেশনা। দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূল দায় অতি-বামপন্থী ব্ল্যাক ব্লকদের। এরপর আন্দোলনটাকে আরও শান্তিপূর্ণ চেহারা দেওয়া হয়েছে। ৫ মে সেটাই দেখলাম।
ফ্রান্সে এসে আরও অনেক কিছুর মধ্যে তাদের আন্দোলনটাও শিখে গেলাম। মন্দ কী!

শাহানুর মুন্না: প্যারিস, ফ্রান্স।