একজন অশিক্ষিত মা

লেখকের মা
লেখকের মা

আমার মা ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে শেষের দিক থেকে দ্বিতীয়। তাই আমার মনে হয় একটু আদুরেই ছিলেন। কারণ আমি ছোটবেলায় তাঁর গায়ের যে রং দেখেছি, এখন পর্যন্ত এমন গায়ের রঙের মেয়ে দ্বিতীয়টি আমি দেখিনি। বিয়ে হয়ে আমার দাদির সংসারে এসেছিলেন অনেক কিছু নিয়ে, যার সবকিছুই আমার দাদি তাঁর একনায়কতান্ত্রিক পরিবারে গলাধঃকরণ করেছিলেন। কিন্তু যেটা আমার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেননি, সেটা হলো তাঁর গায়ের রং। ছোটবেলায় মা আমাকে একপাশে আর আমার মেজো ভাইটাকে অন্য পাশে নিয়ে ঘুমাতেন। আমি মাঝে মাঝে তাঁর হাতে আমার ছোট হাতের সরু আঙুল দিয়ে চিমটি দিতাম, তাতেই তাঁর হাতে রক্ত জমে যেত। পরবর্তীতে একান্নবর্তী পরিবারের ঘানি একাই টানতে গিয়ে সেটাও খুইয়েছেন। আমি এখনো মাঝে মাঝে তাই মাকে চিনতে পারি না। কারণ তাঁর সেই গৌর বর্ণের সঙ্গে আজকের গায়ের রংকে কোনোভাবেই মিলাতে পারি না।

আমার আমি হয়ে ওঠার পেছনে এই মহীয়সী নারীই আসল কারিগর। কারণ আব্বা দিন-রাত কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। নদী ভাঙনের পর শহরে এসে আমরা পড়লাম অকূলপাথারে। তখন আমার মা-ই শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সব মানুষই আমার বয়সী ছেলে-মেয়েকে কাজে দিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই যে অভাবে পড়ে দিয়েছিলেন তা কিন্তু না। কেউ কেউ দিয়েছিলেন যাতে তারা নিজেরা একটু সুখে-শান্তিতে থাকতে পারেন। কিন্তু আমার মা শত অভাবের মধ্যেও আমাদের কাজে পাঠাননি। বলতে গেলে গ্রামের পরিবেশে স্রোতের প্রতিকূলে যাত্রা এবং সেই যাত্রাতে তাঁর কোনো সঙ্গী ছিল না।

সবে ছোট ওয়ান শেষ করে বড় ওয়ানে উঠেছি। নতুন ক্লাসে সবাইকে নতুন বই দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাকে দেওয়া হলো না। কারণ বই নিতে গেলে স্কুলের ফিস বাবদ দশ টাকা দিতে হবে। যারা আমার বয়সী তারা জানেন সেই সময়ে দশ টাকা মোটেও কম টাকা ছিল না। বিশেষ করে আমাদের মতো পরিবারের জন্য। আমি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে হাজির। মা কোথা থেকে যে টাকাটা জোগাড় করলেন সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আমার লেখাপড়ার গাড়ি চলতে শুরু করল এবং এখন পর্যন্ত চলছেই। উপরন্তু পাশের বাড়ির সাকেরা বুর কাছে আমাকে প্রাইভেট পড়তে দিলেন। যার হাতেই আমার অক্ষরজ্ঞান ও হাতেখড়ির শুরু। মা কখনোই পড়াশোনা নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা করতেন না। তবে যেটা করতেন, দিনে অন্তত একবার মনে করিয়ে দিতেন পড়া হয়েছে কিনা? শুধু এই একটা কথাতেই আমি আমার বাড়ির কাজ সব রেডি করে তারপর খেলতে যেতাম। ঢাকায় আসার পর শুধু ওই একটা কথা বলার মানুষ না থাকার কারণে আমি আর কখনোই পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারিনি।

রাত জেগে পড়াশোনা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলে আমার অশিক্ষিত মা একটা মোক্ষম ওষুধ দিতেন। মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে নারিকেলের তেল হাতে নিয়ে অনেক ঘষে ঘষে মাথার চাদিতে দিয়ে দিতেন। তারপর হাতের মধ্যে সামান্য পানি নিয়ে সেটা তেল মাখানো জায়গায় দিয়ে দিতেন। আর আমি ধীরে ধীরে মায়ের কোলে ঘুমে ঢলে পড়তাম। যত দিন কুষ্টিয়াতে থেকে পড়াশোনা করেছি তত দিন পর্যন্ত মাথার যন্ত্রণা দূর করার জন্য এটা ছিল আমার মায়ের একমাত্র ওষুধ। এরপর ঢাকা হয়ে এখন অস্ট্রেলিয়া আছি। এখন মাথা যন্ত্রণা শুরু হলে প্রথমে চা খেয়ে সেটা তাড়ানোর চেষ্টা করি। তাতেও সফল না হলে প্রথমে প্যানাড্রল তারপর নিউরোফেন পর্যন্ত খাওয়া হয়। কিন্তু সব সময় যে তাতে ব্যথা দূর হয় তা কিন্তু নয়। তখন বারবার আমার অশিক্ষিত মায়ের হাতের সেই মোক্ষম দাওয়াইয়ের কথা মনে পড়ে যায় আর অজান্তেই স্মৃতিটা ঝাপসা হয়ে আসে।
আমার প্রতি আমার অশিক্ষিত মায়ের স্নেহের সামান্য নমুনা দিই। আমি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর জীবনে প্রথম তাঁকে ছাড়া জীবনযাপন শুরু করলাম। বাড়িতে থাকতে তো কোনো কাজই নিজে করিনি। এমনকি গোসল করে নিজের পরনের কাপড় ধোয়া পর্যন্ত সবই মায়ের কাঁধে চাপিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াতাম। তাই ঢাকায় এসে প্রথমবার কাপড় ধুতে গিয়ে হাতের আঙুল সামান্য ছিলে গিয়েছিল। যেহেতু তখন এখনকার মতো মোবাইলের যুগ ছিল না। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র ও কারও মাধ্যমে খবর পাঠানো। আমি মাকে খবর পাঠিয়েছিলাম আমার হাত কেটে যাওয়ার কাহিনি। এরপরের সপ্তাহে বাড়ি গিয়ে শুনি আমার অশিক্ষিত মা এই কয়দিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেননি। সারাক্ষণ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন কখন আমি বাড়ি ফিরব? তাঁর একটাই কথা আমি বেঁচে থাকতে আমার ইয়াকুব কাপড় ধুতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। এটা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি কুষ্টিয়াতে ফিরতে সব সময়ই আমার মাঝরাত হয়ে যেত। সাধারণত দেখা যেত শুক্রবারের ক্লাস শেষ করে বিকেল বা সন্ধ্যার বাসে উঠতাম। সেটা কুষ্টিয়া গিয়ে পৌঁছাত রাত ১টা–২টার দিকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাড়িতে গিয়ে আমি শুধু একবার ডাকতাম—‘মা’। সঙ্গে সঙ্গে আমার মা দরজা খুলে দিতেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি রাতে ঘুমাও না। তাহলে কীভাবে টের পাও যে, আমি এসেছি। এর উত্তরে আমার মা শুধুই হাসতেন। ইদানীং একটা ব্যাপার আমাকে খুবই পোড়ায়। কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর দেশের বাড়িতে যাওয়া ধীরে ধীরে কমে গেল। একদিন আমার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে মা বলেই ফেললেন, সেদিন স্বপ্নে দেখেছেন যে, আমি বাড়ি গিয়ে তাঁকে ডাক দিয়েছি। এরপর স্বপ্ন ভেঙে গেলে আমার মা সারা রাত বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিয়েছেন এই ভেবে, যদি সত্যি সত্যিই আমি আসি তাহলে দরজা খুলতে যেন দেরি না হয়।
আমার মাই এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মানসিক অবলম্বন। চেনাজানা পরিবেশ স্থায়ী সরকারি চাকরি ছেড়ে যখন একেবারে নতুন একটা দেশে নতুন একটা পরিবেশ অস্ট্রেলিয়াতে পাড়ি জমাচ্ছি, তখন তিনি আমাদের বিদায় দিতে ঢাকা আসলেন। আসার পর একদিন আমার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন তুমি একদম ভেব না সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি যখন ঢাকায় এসেছিলে তখনো তোমার ঢাকাতে কেউই ছিল না, এখন কত আত্মীয়স্বজন তোমার। ঠিক একইভাবে অস্ট্রেলিয়াতেও তোমার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মনে রেখ যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন। আমার অশিক্ষিত মায়ের এই একটিমাত্র কথা আমার মনে যে সাহস জুগিয়েছিল, সেটার কোনো তুলনা নেই। অস্ট্রেলিয়ার জীবনের একেবারে শুরুর দিনগুলোর কঠিন সময়ে আমার শুধু মায়ের এই কথাগুলো মনে হতো আর মনে আবারও শক্তি ফিরে পেতাম অবিরত লড়ে যাওয়ার।
মা আমি তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলাম না, এখনো নেই। আমি তোমাকে যে কী পরিমাণ অনুভব করি, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। তাই তোমার সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন ভাব দেখাই যেন তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমি বিরক্তি বোধ করছি। আসলে কিন্তু উল্টো। তুমি যাতে মনে কর আমি সবকিছু মিলিয়ে অনেক ভালো ও ব্যস্ত আছি তাই তোমাকে আর আগের মতো মনে পড়ে না এবং তুমি যেন আর আমার পথ চেয়ে না থাক। ঢাকা শহর আমার ভেতরের অনেক ভালো গুনকেই কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু মায়ের জন্য আমার প্রাণের গহিন কোণে যে ভালোবাসার ছোট অথচ তীব্র অনুভূতি সেটা কখনই কেড়ে নিতে পারেনি। এমনকি উন্নত বিশ্বের যান্ত্রিকতাও মায়ের প্রতি আমার অনুভূতিটা কেড়ে নিতে পারবে না। আমি বিশ্বের যে প্রান্তেই যাই না কেন, যে অবস্থাতেই থাকি না কেন মা সব সময়ই আছ আমার অন্তরে।
মাকে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না কখনোই। আসলে মা-বাবা সব সময়ই আমাদের মাথার ওপরে একটা অদৃশ্য ছাতা হয়ে থাকেন। আপনি আপনার মা-বাবার কাছ থেকে যতই দুরে থাকেন না কেন, তারা আপনার কোনো উপকারেই হয়তো আসছেন না, তবুও এই মানুষগুলোর প্রয়োজনীয়তা আপনার জীবনে ঠিক কতখানি সেটা বুঝবেন যখন তাঁরা আর থাকবেন না। সবচেয়ে বড় বিপদের মুহূর্তগুলোতে এই মানুষ দুজনই নিঃস্বার্থভাবে আপনার পাশে থাকেন সব সময়। আমি একবার কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুবই মন খারাপ করে আছি আবার কাউকে বলতেও পারছি না। তখন মাকে ফোন দিয়ে বললাম সমস্যাটার কথা। আমার অশিক্ষিত মা আমাকে শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে যে সাহসটা দিলেন তার কোনো তুলনা নেই। আমি পূর্ণ উদ্যমে আবার জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে আসলাম। কারণ একজন বাবা-মাই জানে তার ছেলেমেয়ের সবচেয়ে দুর্বল দিক কোনটি আবার সবল দিক কোনটি। তাই তাঁদের উপদেশগুলো বাস্তব জীবনে মেনে চলতে পারলে আপনি একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন নির্দ্বিধায়।
আমি এই লেখাতে যতবারই মায়ের প্রসঙ্গ এসেছে ততবারই আমি অত্যন্ত সচেতনভাবে অশিক্ষিত বিশেষণটা ব্যবহার করেছি, কারণ অশিক্ষাটায় ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় শিক্ষা। অশিক্ষার কারণে তিনি হয়তো আমাদের লেখাপড়া নিয়ে অতটা খবরদারি করতেন না, যতটা একজন শিক্ষিত মা করতেন। এর ফলে আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে নিজেদের পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। যার সুফল এখনো আমরা ভোগ করে যাচ্ছি। আসলে একটা সময়ের পর প্রত্যেকটা মানুষকেই স্বাবলম্বী হয়ে জীবনে চলতে হয় আর সেই শিক্ষাটা যদি আপনি আগে থেকেই পেয়ে যান তাহলে ভবিষ্যতে যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সমাধান করে ফেলতে পারবেন। আমার মনে হয় তিনি যদি শিক্ষিত হতেন তাহলে কখনোই আমরা তিন ভাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজ নিজ কর্মে সাফল্য লাভ করতে পারতাম না। অনেকবার ভেবেছি মায়ের জন্য রত্নগর্ভা জননীর পুরস্কারের জন্য আবেদন করি। তখন মনে হয়েছে কী দরকার। আমরা তিন ভাই তাঁর জন্য তিনটা পদকের সমান।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।