একটি অন্য রকম বিকেল

ছেলের সঙ্গে লেখিকা
ছেলের সঙ্গে লেখিকা

গাড়ি ছুটে চলেছে সানফ্রান্সিসকো শহরতলির দিকে। চারদিকে নয়নাভিরাম দৃশ্য। সবুজ পাহাড়ের আড়ালেই আছে সমুদ্র সৈকত। যেহেতু নিজে গাড়ি চালাচ্ছি না, মন ভরে উপভোগ করছি প্রকৃতির দান। একটু চিন্তায় আছি, একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাব। একটু আগে তিনি একটি রেস্তোরাঁর ঠিকানা পাঠিয়েছেন। গাড়ির চালককে একটু অনুনয় করে বলতে হলো, যদিও আগে থেকে এই গন্তব্য ঠিক ছিল না, তিনি কি পারবেন আমাকে এই নতুন ঠিকানায় নামিয়ে দিতে।

চালক ভালো ছিলেন। এর আগে তাঁর সঙ্গে আমার প্রায় আধা ঘণ্টা আলাপ হয়েছে। আমি তাঁর জীবনের সারাংশ জেনে গেছি। আমার শরীর খারাপ লাগছিল। আমাকে এক বোতল পানিও দিয়েছেন নিজে থেকে। তাই তিনি এই অনুরোধে রাজি হয়ে গেলেন সহজেই। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা এসে গেলাম একদম সমুদ্রের পাশের রাস্তায়। গাড়ি এসে থামল সমুদ্র সৈকতের ধার ঘেঁষে এক রেস্তোরাঁয়। আমি গন্তব্যে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
ভেতরে ঢুকতেই বুঝলাম, এই রেস্তোরাঁটা আমার দেখা অন্য সবগুলোর চেয়ে আলাদা। কোনো এক দেশের ঐতিহ্যের ছাপ স্পষ্ট। তারপরেই তাঁকে দেখতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে গেল। আমাকে দেখে বিনম্রভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি কাছে যেতেই আলতো করে জড়িয়ে ধরল। বসতে বসতেই আমার মনে হচ্ছিল সমুদ্র সৈকতের আলো বাতাস যেন খেলা করছে এখানে। তখনো বিকেল। আমার মাথা ব্যথা, শরীর খারাপ সব উধাও। এতই ভালো লাগছিল যে, উঠে গিয়ে বাথরুমে একটু ফ্রেশও হয়ে এলাম। লিপস্টিক–পাউডারের ছোঁয়া।
আমরা অচেনা কিছু মজার খাবার অর্ডার দিলাম। সে বারবার নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল যেন আমার পছন্দমতো খাবার অর্ডার করি। আর আমি জানি, আজকে বেশ কয়েক দিন পরে সে ভালো কিছু খাচ্ছে। তাই চাইছিলাম তাঁর মন মতো অর্ডার হোক। খাওয়ার পরিমাণ খুব বেশি নয়, আশা করেছিলাম আরেকটু বেশি হবে। ভাগাভাগি করে খেলাম। আমার প্লেট থেকে কিছুটা তাঁকে তুলে দিলাম এই বলে যে, আমার খিদে নেই। আসলেই তাঁকে দেখে আমার খিদেও চলে গেছে। বেশ চাঙা বোধ করছি এমনিতেই। দুজনেই খাওয়াটা খুব উপভোগ করলাম।
সে বেশির ভাগ সময়ই চুপচাপ, তবে আমি কেমন আছি সেটা ভালো করে জেনে নিয়েছে। কী করছি এখন, সামনে কী করব সব গল্পই হলো। নিজের সব খবরাখবর দিল, কাজের ঝামেলার কথা শোনলাম। যেটুকু কথা বলে, একদম বুকের ভেতর থেকে। আর আমাকে সে অনেক বিশ্বাস করে, অনেক নির্ভর করে আমার ওপরে। আমিও করি, এভাবে মন প্রাণ খুলে কথা বলতে পেরে খুব হালকা লাগছে।
খেয়ে দেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। তখনো বিকেলের আলো আছে। সমুদ্রের পার ধরে আমরা অনেকক্ষণ হাঁটলাম। হাত ধরে, কখনো জড়িয়ে ধরে। কোনো তাড়াহুড়া নেই। ইচ্ছে হলো এক জায়গায় বসলাম। কিছুক্ষণ জাহাজ দেখলাম। আকাশ, ব্রিজ। সাদাকালো এক ধরনের পাখি দেখে সে কী খুশি। মানুষের ভিড় নেই একদম। দুই-চারজন এসেছেন সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে, সঙ্গে কুকুর। সেগুলো নিয়ে গল্প হলো। এমন ঢিলেঢালা ভাবে নির্মল বাতাস, নীল আকাশ আর সমুদ্রের নীলের মাখামাখি অনেক দিন উপভোগ করিনি।
সন্ধ্যা যখন ছুঁই ছুঁই করছে, তখন একটা কফি শপে ঢুকলাম।
আমাদের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। কফি খেতে খেতে প্ল্যান করছি আমি কীভাবে ফিরব। আমার ইচ্ছে ট্রেনে ফিরব। সে বাধা দিল।
—রাতের বেলা এই ট্রেনে যাওয়া তোমার জন্য খুব নিরাপদ নয়। পরিবেশ ভালো না।
—তুমি যে যাও? আমিও জেদ ধরলাম।
—আমার অসুবিধা হয় না। সংক্ষিপ্ত উত্তর।
কফি শেষ করে নিজেই গাড়ি ডেকে তুলে দিল। গাড়িটা যখন মোড় নিচ্ছে, আলো ঝলমল সানফ্রান্সিসকোর রাতের স্ট্রিট লাইটের আলোতেই আমি দেখলাম আমার বাবাটা হেঁটে যাচ্ছে ট্রেন স্টেশনের দিকে। উনিশ পেরোনো তরুণ।
এত সুন্দর একটা বিকেলের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। আমার চোখে পানি আসছিল আর প্রার্থনা করছিলাম, হয়তো অনেক দিন পরে এমনি করে এক বিকেলে ওর মেয়ের সঙ্গে ও দেখা করতে আসবে।
মা দিবসে সকল মায়েদের জন্য মন থেকে শুভেচ্ছা। মা হতে পেরে আমি আনন্দিত, মায়ের প্রাপ্তি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মা হয়েছিলাম বলেই সেদিন এমন এক অসামান্য সময়টা পেয়েছিলাম, যে সময়ের জন্য আমি সারা জীবন অপেক্ষা করতে রাজি।

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।