মায়ের জন্য

লেখকের মা
লেখকের মা

নটর ডেম কলেজের সায়েন্সের ছাত্র আমি। মা–বাবার আশা অনেক ভালো ফলাফল করে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার হব। পরীক্ষা শুরুর কিছুদিন আগে হঠাৎ করে আমার পেটের ডান দিকে প্রচণ্ড ব্যথা। কিছুতেই কমে না। ডাক্তার এলেন। যন্ত্রণায় কেঁদে কেঁদে আমি অস্থির। ভালো ভাবে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা। আজকেই অপারেশন করতে হবে। এদিকে দুই দিন পরেই কোরবানির ঈদ। গরু কেনার জন্য যাওয়ার কথা পরের দিন। অপারেশন করতে টাকা দরকার।

এটা ২০০২ সালের কথা। সে বছর কোরবানি না দিয়ে আমার অপারেশন করা হলো। জ্ঞান ফিরে তাকিয়ে দেখি, মা দাঁড়িয়ে আছেন। মায়ের চোখ ভরে আছে পানিতে। বললেন, বাবু তুই ঠিক আছিস? বুকটা কেমন করে উঠল। মায়ের সেবায় ধীরে ধীরে ঠিক হতে থাকল। অনেক হাই পাওয়ারের ওষুধ খাওয়ার জন্য সারা দিন শুধু ঘুম আসত। পরীক্ষার কথা তখনো মাথায় ছিল না। কিন্তু প্রস্তুতি তো নিতে হবে। কী আর করা।
আমার মা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। এক জায়গায় মডেল টেস্ট দিচ্ছিলাম তখন। সেখানে রিকশায় করে মায়ের সঙ্গে যেতাম। আমার মনে আছে, মা আমাকে শক্ত করে ধরে রাখতেন আর দোয়া পড়তে থাকতেন, রিকশার ঝাঁকুনি থেকে রক্ষা করার জন্য। তিন ঘণ্টার মডেল টেস্ট দিতাম। খেয়াল করে দেখলাম, যে রকম প্রস্তুতি আমার থাকার কথা ছিল, তার থেকে আমি কিছুটা পিছিয়ে আছি। অনেক সময় হঠাৎ করে সব অন্ধকার দেখতাম। মাঝে মাঝে একটু বাইরে তাকিয়ে দেখতাম মা বাইরে একটা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন।
সারা দিন চাকরির পর মাকে বিকেলে এভাবে তিন ঘণ্টা বসে থাকতে দেখে খুব খারাপ লাগত। মাকে বললাম, মা, আমার পরীক্ষা খুব ভালো হচ্ছে না। যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, তেমন হচ্ছে না। মা বললেন, চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখতে দেখতে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। মা যথারীতি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন আর দোয়া পড়তে থাকেন। আমি পরীক্ষা দিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট হচ্ছিলাম না।
পরীক্ষা শেষ করে রেজাল্টের জন্য তখন অপেক্ষা। আমি মোটামুটি ধরে রাখলাম, মোট ছয়টা বিষয়ের মধ্যে হয়তো শুধু গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞানে লেটারস মার্কস থাকবে (প্রতি বিষয়ে দুই পত্রে মোট ২০০ নম্বর। ১৬০ পেলে লেটারস মার্কস)। মা বললেন, দেখবি রসায়ন আর জীব বিজ্ঞানেও থাকবে। চিন্তা করিস না। আমি ভাবলাম, মা এত সাহস পান কোথায়? পরীক্ষা দিলাম আমি আর তিনি কিনা বলে দেন মার্কস কত পাব!
রেজাল্টের দিন মায়ের সঙ্গে রওনা দিলাম। খুঁজে বের করলাম আমার রোল নম্বর। অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যিই চার সাবজেক্টে লেটারস মার্কস। মা যেন বিড়বিড় করে কার সঙ্গে কথা বলে নিলেন। এ রকম একের পর এক মায়ের দোয়ায়, জীবন পার করে দিচ্ছি। মায়ের দোয়ায় একে একে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি শেষ করে ফেললাম।
মা, তোমার এই দোয়াগুলো আমার অনেক দরকার। যত দিন বেঁচে আছি তোমার এই দোয়াগুলো যেন আমার সঙ্গে থাকে। কালের পরিক্রমায় আজকে আমিও সন্তানের বাবা। মা, আমি চাই আমার সন্তানকে যেন ঠিক একই ভাবে, তোমার মতো করে মানুষ করতে পারি। আমার জন্য দোয়া করো মা।

ড. মুহিদুল ইসলাম খান: গবেষক, তালিন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি, এস্তোনিয়া।