একজন নারী যিনি ছিলেন আমার মা

লেখক
লেখক

মনের ভেতর আঁকা ছবিগুলো মনের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছি আর মাঝে মাঝে হৃদয়ের সেই ছবিগুলো দেখি। আজ এমন বিশাল একটি ছবির গল্প বলব যা শিশুকাল থেকে শুরু করে যৌবনকাল অবধি দীর্ঘ সময় ধরে মনের মাঝে অঙ্কন করেছি।

একদিন দুপুরবেলা, মা আমকে ঘুম পাড়ানোর অনেক চেষ্টা করছিলেন। আমি কোনোভাবেই ঘুমাব না। কারণ ঘুমালে খেলতে পারব না। তখন জীবন মানে খেলা! গ্রীষ্মের দুপুরে মায়ের কাছে পাটির বিছানাতে শুয়েছিলাম। মার এক হাতে নারিকেল পাতার চিকন কঞ্চি আর অন্য হাতে হাতপাখা। কঞ্চিটি রেখেছেন আমাকে ভয় দেখানোর জন্য। মাইরের ভয়ে আমি যাতে ঘুমিয়ে পড়ি।
এদিকে আমার একটি বাড়ি বানানোর কথা ছিল। আমাদের ঘরের পেছনে কলাগাছের বাগান ছিল। সেখানে কলাগাছের পাতা দিয়ে বাড়ি বানাব। সকাল থেকে সে ঘরটি বানাবার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম। বাঁশ বাগান থেকে ঘরের খুঁটিগুলো কেটে এনেছি। ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। মা ঘুমিয়ে পড়লে, শব্দহীনভাবে মায়ের পাশ থেকে ঊঠে কলা বাগানে চলে গেলাম। ঘর বানানো শুরু করে দিলাম। কলা পাতার ছাউনি ও বেড়া দিয়ে সুন্দর একটি ঘর তৈরি করলাম। আমার বন্ধুরা ঘর দেখে অবাক হলো। অনেকক্ষণ ঘরটির ভেতরে বসে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম এই ঘর দিয়ে কী করা যায়। মাথায় একটি দোকান করার ভাবনা এল। যেই ভাবা সেই কাজ। আমার জমানো কিছু টাকা ছিল। টাকাগুলো নিয়ে জোলার হাটের মোড়ের দোকান থেকে কিনে আনলাম আচার, চকলেট, বিস্কুট ও কিছু প্লাস্টিকের খেলনা। দোকান সাজিয়ে বসে পড়লাম। বেচা-বিক্রি শুরু করে দিলাম।
অন্যদিকে মা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে কলা বাগানের ভেতর আমাকে খুঁজে পেয়ে ভীষণ রাগ করলেন। সে দিন মায়ের হতের ধোলাই খাওয়ার কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তাঁর হাতের কঞ্চি দিয়ে প্রচুর মারলেন। আমার পিট ফেটে রক্ত বের হলো। রাতেরবেলা আমার জ্বর এসে গেল। ব্যথার কারণে আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। মাও সারা রাত জাগ্রত ছিলেন। আমার পিঠে সরিষার তেল মেখে দিলেন। মাথায় পানি ঢেলে ও সারা রাত ক্ষণে ক্ষণে গা মুছে দিয়ে জ্বর নামালেন। সারা রাত মায়ের সঙ্গে অনেক অভিমান দেখালাম। সে রাতে মায়ের চোখের পানির কথা কখনো ভুলব না। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন এবং বললেন, ‘আর কোনো দিন তোকে মারব না।’
মা আমাকে কঠিন শাসন করতেন। তবে তাঁর ভালোবাসার কাছে শাসন ছিল আমার কাছে নস্যি। মাকে একেবারেই ভয় পেতাম না। হাজার মারলেও না। বাবা আমাকে মারতেন না, তবুও তাঁকে বাঘের মতো ভয় পেতাম। মা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমার পড়ালেখার জন্য মার ত্যাগ পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে পারব না।
আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনো মা আমাকে শিশু শ্রেণিতে পড়া বাচ্চার মতো আগলে রাখতেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের রুটিন মার মুখস্থ ছিল। কোন দিন কয়টার ট্রেন ধরে ক্লাসে যেতে হবে তার তা জানা ছিল। সময় মতো আমাকে সকালে ডেকে তুলে নাশতা করাতেন ও ক্লাসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করিয়ে দিতেন। কয়টার ট্রেন ধরে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসব, তাও তাঁকে কখনো ভুলতে দেখিনি।
প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে বাড়িতে ঢোকার সময় মাকে দেখতাম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কখনো তার ব্যতিক্রম দেখিনি। বাড়ি আসতে একটু দেরি হলে, তিনি চিন্তা শুরু করে দিতেন। তাই ক্লাস শেষে আমি কখনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সাহস করতাম না। যে দিন বন্ধুদের সঙ্গে কোনো আয়োজন থাকত, মাকে তা আগে থেকে বলে রাখতাম।
এমনি করে মায়ের কোলে বসেই আমার শিশুকাল থেকে যৌবন কাল কেটেছে। মা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে আমাকে ছেড়ে মা পরপারে চলে যান। আমার মা শাড়ি কিনতে খুব পছন্দ করতেন। মায়ের খুব আশা ছিল, পড়ালেখা শেষ করার পর চাকরি করে তাঁকে অনেক শাড়ি কিনে দেব। মাস্টার্স পাস করার পর মা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। যেখানে যেতেন আমার মাস্টার্স পাস করার বিষয়টি গর্ব করে সবাইকে বলতেন।
আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। তবু তিনি জানতেন, পড়ালেখাকে কীভাবে কদর করতে হয়। জীবনের বড় দুঃখ হলো, মা আমার চাকরি দেখে যেতে পারেননি। মা মারা যাওয়ার তিন মাস পর আমার চাকরি হয়েছিল। আমার মনে হয়, কবর থেকে তিনি এখনো আমার চাকরির জন্য আফসোস করছেন! আল্লাহ তাঁকে বেহেশতের সবচেয়ে সুন্দর স্থানটি দান করুন। আমিন।

মোহাম্মদ আবদুল মালেক: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।