বাঁধ ভেঙে দাও

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের অনুষ্ঠানে দুবাইয়ের ইয়াস আইল্যান্ডের গ্রামে রসমঞ্জুরীর পরিবেশনা
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের অনুষ্ঠানে দুবাইয়ের ইয়াস আইল্যান্ডের গ্রামে রসমঞ্জুরীর পরিবেশনা

বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও।...

গান জানি না। কিন্তু তারপরও কণ্ঠে চলে আসে সুর।
সুতরাং ভয় কী আর! দুটি আয়োজন। অংশগ্রহণের বেলায় দুটোতেই কিছু না কিছু বাধা ছিল। কিন্তু সে বাধা ধোপে টেকেনি।
গত সোমবার (৭ মে) আন্তর্জাতিক নৃত্যদিবস পালন করল আবুধাবির ইন্ডিয়া সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। নৃত্য জগতের চার শিক্ষক নেচেছিলেন এ অনুষ্ঠানে। আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন নৃত্যমোদী দর্শক-শ্রোতা।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে প্রদীপ জ্বালিয়ে নৃত্যের উদ্বোধন
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে প্রদীপ জ্বালিয়ে নৃত্যের উদ্বোধন


এ ছাড়া ছিল আন্তর্জাতিক মে দিবস। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পরমত সহিষ্ণুতার অভিধাটি। দুবাই মিনিস্ট্রি অব টলারেন্স। এরই আয়োজন। ৪ মে ওখানে রসমঞ্জুরী নামের নৃত্যের স্কুলটি নৃত্য পরিবেশন করে। সেখানে নৃত্যে অংশ নেয় ইন্ডিয়ান স্কুল। প্রধান অতিথি ছিলেন মিনিস্ট্রি অব টলারেন্স মিনিস্টার। এ অনুষ্ঠানে আপ্যায়িত হয়েছিলেন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের নির্মাণকর্মীরা পর্যন্ত।
ইয়াস আইল্যান্ডের আলদার কো-অপারেটিভ পল্লি। জায়গাটি দুবাইয়ের সীমান্ত, একেবারেই আবুধাবি ঘেঁষা। তবে রাজধানী থেকে দূরত্ব একেবারে কম নয়। এখানে সেদিন অনেক মানুষের সমাগম হয়েছিল। দূর-বন্ধুর সঙ্গে মেলার জন্য অনুষ্ঠানটি সেতু বন্ধনের ভূমিকা নেয়।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের অনুষ্ঠানে আলো-আঁধারি পরিবেশে মায়েরা
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের অনুষ্ঠানে আলো-আঁধারি পরিবেশে মায়েরা


একজন আরেকজনকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে উন্নত একটি সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। পারস্পরিক শ্রদ্ধায় একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। একটি নিরাপদ, স্থায়ী ও আরামদায়ক জীবনচর্চার জন্য এটা বড় প্রয়োজন। দেশ সমাজ এমনকি একটি সংসারের জন্যও সহাবস্থানের গুরুত্ব ঢের। উন্নয়ন এবং সম্মুখে এগোনোর জন্য বিরাট একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত পরমত সহিষ্ণুতাকে ধরে এই চর্চাই করে যাচ্ছে। এ শিক্ষা দেশটির জাতির পিতা থেকে প্রাপ্ত।
রসমঞ্জুরীর নেতৃত্বে দেন এর গুরু কুন্দন মুখার্জি। নানা বর্ণের সমাহার তাঁর কোরিওগ্রাফিতে। আলাদাভাবে নাচছে নৃত্যশিল্পীর একটি উপদল। সেখানে শিল্পী স্বাধীন তার চলনে কিংবা নৃত্যের কারুকার্যে। মঞ্চে আছে আরও উপদল। তারা এক জায়গায় আসছে। প্রাণে প্রাণে মিলছে। ঐকতান দেখানো হয়েছে নৃত্যের এই নির্বাচনে। কুন্দন বলেন, মানুষ আমরা এইভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা নিয়ে একজন আরেকজনের সান্নিধ্যে আসি।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে নৃত্য শেষে শিক্ষকদের সঙ্গে মায়েরা
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে নৃত্য শেষে শিক্ষকদের সঙ্গে মায়েরা


ইন্ডিয়ান স্কুলের পারফরমারদেরও ছিল বৈচিত্র্য। গ্রামীণ সংগীত এনেছে পরম যত্নে। তারই সঙ্গে মিলিয়ে নৃত্য। এ দেশের সংস্কৃতিকে মূল্য দিয়ে তারা তাদের নৃত্যের ধরন ঠিক করেছে। ধ্রুপদি বা শাস্ত্রীয় উপাদানকে বাদ দেওয়া হয়নি। রসমঞ্জুরীর বেলায়ও একই কথা। চর্চিত ধারার সঙ্গে নৃত্যের এই মঞ্চটি কখনো আপস করে না।
নৃত্য হচ্ছে আধ্যাত্মিক চর্চা। শরীরের ভঙ্গিতে সে প্রকাশ। নৃত্য চিরন্তন যোগাযোগের ভাষাকে আরও গতিময় করে। এর বিস্তৃতিতে সাহায্য করে। এর মধ্যে যোগ করে আনন্দোচ্ছ্বাস। তৈরি করে নান্দনিক সৌন্দর্য এবং তা মানবিক জ্ঞানকে এগিয়ে নেয়।
নৃত্য দিবসে মঞ্চে এলেন পার্বতী অখিলেশ। তাঁর গুরু শ্রীমতি ভি মাইথালি। শিল্পী ভরতনাট্যম চর্চা করেন। তিনি দুর্গা চরিত্রের রূপায়ণ করেছেন। দেবী দুর্গা শক্তির আঁধার। দেবতাদের দেবতা। সব রকম চিত্রকলা ও সংগীত নৃত্যের দেবী। তাঁকে আরাধনা করা হয়। তাঁর পূজা দেওয়া হয়। তাঁর অসীম করুণা। পার্বতী মঞ্চে শক্তি রূপিণীকে তুলে আনলেন দারুণ মুনশিয়ানায়।

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছেন চার নৃত্য শিক্ষক
আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করছেন চার নৃত্য শিক্ষক


কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি একটি কবিতা থেকে নিয়েছেন আজকের কাহিনিটি। সুব্রমনিয়া ভারতীর লেখা।
কেরালার এ কবি পৌরাণিক বিষয় নিয়ে কবিতা লেখেন। এ নৃত্য তারই এক কবিতার সফল মঞ্চায়ন।
কুন্দন মুখার্জি একটি তারানা নাচলেন।
বিরজু মহারাজের রচনা। এটা একটি মিশ্রণ।
রাগ কলাবতী, তাল তিনতাল।
ধিন তা না না...ধিন তা না না, কুন্দন নাচলেন ওস্তাদি নাচ।
দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ হলেন।
আরেকটি নাচ ছিল ঠুমরি। শাস্ত্রীয় নৃত্য। নাট্য সম্পর্কিত। রাগ মালকোশ। উত্তর প্রদেশের পল্লিগীতি যোগ আছে। মোহাম্মদ রফির সুর। মঞ্চ হেসে উঠল। দর্শক শ্রোতার মুখও উজ্জ্বল তখন।
শ্রীমতি রাশিকা ঝাঁ। তিনিই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন।
রাসলীলায় ধরণি হয়ে ওঠে বৈকুণ্ঠ। এ যে স্বর্গের কথা, পুণ্যময় বচন! নিমীলিত চোখে বসা এক তপস্বী।

সাজসজ্জার পর রসমঞ্জুরীর মেয়েরা
সাজসজ্জার পর রসমঞ্জুরীর মেয়েরা


সাধনা করছেন ঈশ্বরের। ভক্তিতে হৃদয় ঢেলে দিয়েছেন। বলুন তাঁকে। এবার তাকান। দেখুন। …অলৌকিক কাণ্ড! সামনে নারায়ণ। মাথা নিচু হয়ে আসে। উচ্চারিত হয়, ওম নারায়ণ। ভরতনাট্যম তাঁর অনুশীলন।
তিনি একজন লেখক। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। বললেন, আমরা চলছি, বলছি, নৃত্য এদের মধ্যে একটি বন্ধন তৈরি করে। নৃত্য আমাদের জীবনেরই অংশ, মিলিয়ে দেখুন, বলেন তিনি।
শ্রী ধর্মরাজ। তাঁর চর্চা মোহিনী নাট্যম।
হাতে চুড়ি, কানে ফুল। পরনে ধুতি। গলায় মালা। নাচছেন, পূর্ণ দৈর্ঘ্য সে নৃত্য। তিনি নেচে যাচ্ছেন।
দর্শকেরা বিমোহিত। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নাচের বিষয়।
সব শেষে চারজন মিলে যৌথ নৃত্য।
সেদিন বিকেলবেলা। তখন ঘুম ঘুম চোখে আমি। একসঙ্গে অনেকগুলো ক্রিং ক্রিং শব্দ বেজে ওঠে। অগত্যা আমিই ধরলাম ফোনটা। ও প্রান্তে রসমঞ্জুরীর সংগঠক ধীরা মুখার্জি। যাবেন না, দাদা! না-হ্যাঁ কিছু বলছি না। নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠান! ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন।...আচ্ছা দেখেছিলাম ফেসবুকে। কিন্তু তারিখটা খেয়াল করিনি। সেটটি দিলাম লাকি হালদার উল্কার কাছে। সময় মাত্র ৩০ মিনিট। প্রস্তুত হতে হবে। হয়েও গেলাম। তারপর সোজা আইএসসি।
দেখা হলো সোনা ব্যানার্জির সঙ্গে। তাঁরা এসেছেন। একটু পরে সঙ্গে তাঁর কন্যা। ভালো লাগার প্রকাশ। শুরুতেই পাশাপাশি বসার সুবাদে কথা হয় অম্বিকা খেতাওয়াদের সঙ্গে। কন্যা অনুষ্কা তাঁর সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয় ডাক্তার কৃষির সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে দুই কন্যা তানভি ও তৃষা। মোহিনী নাট্যম শেখে তারা।
এরপর অদ্বিতি হাজরা। মিসেস ধানিয়া এসেছেন। নন্দা তার কন্যা। ওডিশির মেধাবী ছাত্রী। নৃত্য শেষে কথা। ছবি না হলে যে জমে না। দাঁড়ালেন মায়েরা—আজ যাঁরা একটু ভিন্ন পরিবেশে নৃত্য দেখলেন এবং উপভোগ করলেন। উমা অনিল কুমার আছেন সে দলে। অভিরামিও ব্যস্ত ছবি তুলতে। ওরা মঞ্চে নাচে। ওদের ছবি তোলে অন্যরা। আজ গুরু নাচছেন। সুতরাং আলোক চিত্রায়ণে এ সুযোগ হাত ছাড়া করবে কেন! ছোটরা দাঁড়ায় বড়দের সামনে। আমি ক্লিক করি। ফ্রেমে বন্দী হয়ে যায় সবাই।

মহিলা সমিতির সদস্যরা
মহিলা সমিতির সদস্যরা


এরপর আসি মে দিবসের অনুষ্ঠানে। আয়োজনটি দুবাই সরকারের। নৃত্য তাদের পছন্দ। সে কারণে আবুধাবি ভারতীয় মহিলা সমিতির সঙ্গে কথা বলে তারা। আবার মহিলা সমিতির আছে রসমঞ্জুরীর ওপর এক ধরনের নির্ভরতা। তাইতো তাদের কোনো অনুষ্ঠান এলেই আহ্বান করে এদের।
ঠিক এই হিসেবে থেকে মঞ্চায়নের আগে দুবাই থেকে একাধিকবার আসে রসমঞ্জুরীর মহড়া দেখতে। মহিলা সমিতি এ ক্ষেত্রে দায়িত্বটা পালন করে একান্তভাবে। একান্তভাবে বলছি এই জন্য যে, মহিলা সমিতির নেতৃস্থানীয় সদস্যরাও রসমঞ্জুরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাঁদের কন্যারা এখানেই নাচ চর্চা করে।
রসমঞ্জুরির সঙ্গে আমাদেরও হৃদয়ের সম্পর্ক। সে কারণে সেদিন সাজসজ্জার পর্বটি সারা হয়েছিল আবুধাবির আমাদের বাসভবনে। এখানে মহিলা সমিতির তাঁরা এলেন রসমঞ্জুরির ছাত্রীদের মা পরিচয়ে।
আরুশির মা অর্চনা কুমার। সাজালেন মেয়েকে। রশ্মি ঝাঁ তাঁর কন্যা রুচিকাকে তিলোত্তমা করে তুলবেন। অনুরাধা আইমা শ্রুতিকে নিয়ে একটু বেশি সময়ই দিচ্ছেন বলা যায়। ভাবনা সুরানি শেষ ছোঁয়াটা দিচ্ছেন রেয়ার গালে মুখে। মেঘা ভাট উন্নতিকে নিয়ে আগে ভাগেই বসেছেন। তানু কুশাল, ফারজানা বাসরাই তাঁরা দুজন বসা। সঙ্গ দিচ্ছেন। সানভির সাজ ততক্ষণে হয়ে গেছে।
এদিকে মণিকা বাপনার বিশ্রাম নেই। মানশ্রীকে নিয়ে তাঁরও গবেষণা। তাসনুভা, শর্বরী ও দুর্বার সাজ হয়ে গেল। তিনজনই সন্তুষ্ট আজ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে তারা।
খুব ব্যস্ত সবাই ওদিন। বাস দাঁড়িয়ে নিচে। তর সয় না। এদিকে আমরাতো ঘর না গুছিয়ে আসতে পারি না। সিদ্ধান্ত ছিল আগেরই। ভিন্ন গাড়িতে যাব। তবে পিছে পিছে। কেননা আলদার ভিলেজটি ঠিক ঠিক চিনি না আমি। ভিন্ন গাড়িতেই গেলাম। তবে সরাসরি অনুসরণ নয়। টেলিফোনের নির্দেশ ধরে। দুবাইয়ের নতুন পথ। মূল রাস্তা থেকে অনেকগুলো এক্সিট। তারপর...। আনকোরা এই চালককে বারবার জিজ্ঞেস করতে হয়। তার চাইতে গাড়ির সওয়ারের যেন বেশি উৎকণ্ঠা। ওদিক থেকে কথা বলছেন মণিকা বাপনা। অতঃপর একপর্যায়ে পৌঁছোলাম।
মে দিবসের অনুষ্ঠান ছিল মিনিস্ট্রি অব টলালেন্সের আয়োজন। বাধা ছিল সেখানে। প্রস্তুতির বিষয়, সময় বের করার ব্যাপার। কীভাবে কখন যাবে ছাত্রীরা। তাঁদের অভিভাবকেরাই বা শামিল হবেন কখন! সমস্যা ছিল নৃত্য দিবস উদ্‌যাপনেও। আয়োজনটি করেছিল ইন্ডিয়া সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। তারপরও হল মিলছিল না। তবে সব সমস্যা, সব বাধা কেটে যায় একপর্যায়ে। ওই যে শুরুতেই গানটা গলায় ভাজছিলাম। ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও। …আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ কোন নূতনেরই ডাক।
আসলে নৃত্য বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কোনো বাঁধাই বাঁধা নয় শেষতক।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।