তবে কি ঠিকানা পেয়ে গেছি!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

রোদ নেমে গেছে। ভাতঘুম দিতে বৌদিমণি মেঝেতে বিছিয়েছেন শীতলপাটি। জানলায় এলিয়ে পড়ছে শিউলিগাছটা। মোচার ঘন্ট আর শোল পাতুরির স্বাদটুকু তখনো জিভে লেগে আছে। খোশগল্পও বেশ জমে উঠেছে। আচমকা দরজায় বেল বাজতেই এক দৌড়ে আমি...ততক্ষণে ঝুলি হাতে ডাকপিয়ন ছুটছে। ডাকবাক্সে হাত দিয়ে কুড়িয়ে নিলাম আমাকেই! নীল খামে চিঠি। গোলাপি রঙের প্যাড, ফাউন্টেন পেন আর স্মৃতিকাতর সেই কালির দোয়াত। মিঠে রোদ্দুর ঝলমল করে ছড়িয়ে পড়ছে কপালে, চোখেমুখে। আদুরে বিড়াল পউশি ততক্ষণে একলাফেই বুকের ওপর। স্নেহ আর মুঠোভর্তি আদরের প্রতীক্ষায়।

চিঠিটুকু পড়ব লণ্ঠন বাতির আলোয়, খুব নিরালায়। উঠোনজুড়ে নেমে আসবে রুপালি চাঁদ, আমি মনে মাখব তোকে। দু–চারটা শিউলি ঝরবে, কুড়িয়ে নেব কোঁচড়ে। ভাবতে ভাবতেই নন্দিতা, ও নন্দিতা, ডাকছেন বৌদি। কি লিখেছে রে? বলেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, চোখ জুড়েও। বৌদির চোখে চোখ রেখে আমিও হেসে ফেললাম। কথা হলো চোখে চোখে, মনে মনে।

আমার আর বৌদির সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। আমরা কত কীই না বলি। ভাইকে নিয়ে বৌদির মান অভিমান, অনুযোগ সবটাই বলেন আমাকে। ভাইয়া ও বৌদির খুনসুটির দায়িত্ব আমিও কিছুটা নেই। দুজন ঝগড়া করলে আমি বৌদির পক্ষেই থাকি। আমার চোখেও কখনো কখনো আশ্রয় খোঁজেন বৌদিমণি। আমি ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখি। সব ফেলে এসেছে না!

আমরা এক পথে হাঁটি। আমাদেরও হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। আবার হাত ধরে হাঁটি। আমাকে নিয়ে ভাবেনও! বৌদির চোখ প্রাণচঞ্চল, বেশ আশাজাগানিয়াও তবুও ভরসা খুঁজতে গিয়ে কেন এত বিমর্ষ হয়ে পড়ি! তাহলে কী অন্য বাড়ি একটা মেয়েকে পিছু টানে আজীবন! অনিন্দ্য ঢিপ ঢিপ করে বুকে বাজছে, কাঁপছি আমি। অজান্তেই বৌদিমণির লাল শাড়ির ঘ্রাণটা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। সাতনড়ি হার, মালতী ছড়া আর গুনগুন পারুল সুখ আমাকে স্বপন মাঝির নাওয়ে ভাসিয়ে নিচ্ছে হিজলতলীর ঘাটে। আমি সত্যি সত্যিই লাল বউ!

যে ছাদটাকে নিরাপত্তাবলয় ভাবছি তা হারিয়ে যাবে নাতো? দাদিজানকে বলতে শুনেছি শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের আসল ঠিকানা। তাহলে বিয়ের আগের সময়টুকু। এটা কি শুদ্ধ আর সত্য ঠিকানায় পৌঁছানোর পূর্বের প্ল্যাটফর্ম? ট্রেনের অপেক্ষায়। যেন আরাধ্য ঠিকানায় পৌঁছাব বলে সহস্র বছর ধরেই চলছে বুকের গোপন প্রকোষ্ঠে এক মহতী-প্রার্থনা। তাহলে এত যত্ন আহ্লাদ কেন? এলোমেলো ভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলি মাঝে মাঝেই...।

বৌদিমণি আগলে রেখেছেন বুকের ওম দিয়ে তবুও কেন আমি হন্যে হয়ে অনন্ত ঠিকানা খুঁজছি। ঠিকানা কি আত্মপরিচয়? প্রশান্তি বাড়ি?
কিংবা একটা বিশ্বস্ত ভরসার হাত।
অথবা প্রতীক্ষা...।
বেলাটুকু পড়ে এলেও আলো দিতে জানে।
চিঠি হাতে পেয়ে কেনই বা নিজেকে এতটা নিরাপদ ভাবছি! তবে কি ঠিকানা পেয়ে গেছি!
মেঘ ফিরে এসো
ফেরত চিঠি নিয়ে
লণ্ঠন জ্বালিয়েছি ওই!
ভাবছি তোমাকেই...
বাউল বাড়ি
সাং চম্পকনগর
পোস্ট সোনাপুর
জেলা হবিগঞ্জ।

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।