বেঁধে রাখি তোমায়...

মায়ের সঙ্গে লেখিকা ও তার ভাইবোন
মায়ের সঙ্গে লেখিকা ও তার ভাইবোন

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরলাম একটু আগে। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে আমার। সেদিন আবার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ছিল ইনঅরগানিক কেমিস্ট্রির। দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন থেকে মাত্র দুটি শিঙারা কিনে খেয়েছিলাম আর তখনতো বিকেল চারটা বাজে।

খেতে এসে দেখি, ভাতটা আম্মা বেড়ে দিলেন।
আহ্ আজ দেখি চিংড়ি শুঁটকি দিয়ে কচুর লতি আর কাঁচা আম দিয়ে মলা মাছ। আমি খাচ্ছি আর মনে মনে বলছি, ইশ্‌ আম্মা কী ভালো রান্না করে, আমি যে কখন এভাবে রাঁধতে পারব!
সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম আম্মা এমন একজন, যিনি ঘুম থেকে উঠতেন সবার আগে। দিনরাত শুধু কাজ আর কাজ। কখনো হয়তো তিনি অসুস্থ থাকতেন। কিন্তু আমাদের কখনো বুঝতে দিতে চাইতেন না।
বাসায় খুব মেহমানের আসা যাওয়া ছিল। ইলেকট্রিক হিটারের গনগনে আঁচে তিনি রান্না করতেন। তার ফরসা মুখখানা হিটারের আঁচে টকটকে লাল হয়ে যেত।
একসময় অনেক কষ্ট করেছেন। এখন আর পারেন না তেমন কিছু করতে। খুব কম বয়সেই ডায়বেটিস আর প্রেশারের রোগী হয়ে সারা বছর অসুস্থ থাকেন।
আমরা দুই বোন থাকি দেশের বাইরে। ভাইটাও ব্যাংকের চাকরি নিয়ে থাকে অন্য শহরে।

লেখিকার মা-বাবা
লেখিকার মা-বাবা

আম্মার পাশে থাকে শুধু ছোট বোনটা। সেও তার পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। আম্মা এখন তাই অনেক একা হয়ে গেছেন। ঘরভর্তি তার সন্তানদের কেউই তাঁর কাছে থাকতে পারে না। আমি বলি আম্মা সারা জীবন তো টিভিতে কোনো প্রোগ্রাম দেখলেন না। এখন থেকে একটু টিভি দেখার অভ্যাস করেন। গল্পের বই পড়েন, একা সময়গুলো এমনিতেই ফুরিয়ে যাবে।
দেশে যখন আম্মার বাসায় যাই পারলে যেন তিনি আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেবেন। কত বলি আম্মা আজ আমি রান্না করি, প্লিজ তুমি একটু বসো এবার।
না এটা তিনি হতেই দেবেন না। আরও বলেন আমাকে, তুই কত কষ্ট করিস ওইখানে আমার নাতিদের নিয়ে, এখানে আর কষ্ট করতে হবে না।
মা বুঝি একেই বলে। প্রতিদিন একটু কথা না বললে যেন মনে হয় দিনটা আমার শুরুই হয়নি।
আমার মন খারাপ, অসুস্থ সবকিছুর একমাত্র সমাধান আম্মার সঙ্গে কথা বলা। ঠিক যেন পরশ পাথরের মতো কাজ করে শরীর ও মনের দুঃখ কষ্ট নিমেষেই মিলিয়ে যায় আম্মার সঙ্গে কথা বললে।
যেদিন চলে আসি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কাচের দেয়ালের এপাশে আমি আর ওপাশে আম্মাসহ পরিবারের সবাই। আমরা একে অপরের দিকে চেয়ে থাকি আর মাঝখানে থাকে কাচের দেয়ালটার তৈরি অদ্ভুত এক বিশাল দূরত্ব। সেই দূরত্ব পেরিয়ে আমি আমার মাকে ছুঁতে পারি না।
ধীরে ধীরে তারা হারিয়ে যান আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। আমেরিকায় ফিরে আসার বিমানে আমি বসি ঠিকই কিন্তু হৃদয়ের কিছুটা অংশ বোধ হয় সেই কাচের দেয়ালটার ওপারে রেখেই আসি। যেই দেয়াল পেরিয়ে আমি আর পারি না আমার মাকে শেষ একটিবার জড়িয়ে ধরতে। পারি না আর একটিবার বলতে আম্মা মিস করব তোমাকে।
ভালো থেকো মা, আল্লাহপাক যেন তোমায় দীর্ঘায়ু দেন। তোমাকে তো আমার সঙ্গে বেঁধে নিয়ে আসতে পারি না। কিন্তু বুকের খাঁচায় ঠিকই বেঁধে আনি তোমায়।
এই দূর দেশে থেকেও শান্তি পাই মনে মনে যখন ভাবি মোবাইল বাটন টিপলেই তো তোমার গলাটা শুনতে পাই। দেশে যাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে থাকি, জানিই তো ওধারে তুমি অপেক্ষায় থাক।
আমার মাসহ পৃথিবীর সকল মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা, ভালো থাকুক সকল মা।

রিফাত নওরিন: আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র।