হৃদয় আমার নুইয়ে দাও

মঞ্চে গান গাইছেন শিল্পীরা
মঞ্চে গান গাইছেন শিল্পীরা

আলোকের এই ঝরনা ধারায় ধুইয়ে দাও।

আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও!
একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন তাঁরা। তুমুল এক দ্যোতনা সে গানে। বলা হয়, হে সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল, আমাকে তোমার আলোক রশ্মি দিয়ে ধুইয়ে দাও। দারুণ আকুলতা কবিগুরুর সে গানে। শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে বিশুদ্ধ হওয়ার দুর্নিবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তোমার আলোক রশ্মি দিয়ে, হে মোহন সকাল, আমার মলিনতাকে দূর করে দাও। এ এক প্রার্থনা। যেন সবকিছু ভেঙে ফেলা আকস্মিক! তারই ফাঁকে ছিঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে আলোকধারা। শিল্পীর জয় এখানেই। অনুষ্ঠানের শুরুটা ছিল এমনই।
দুর্গম পাহাড়, বিপদের মরুপথ, দুঃসাধ্য চলা! এমন কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে এগোতে হবে। এ জন্য সতর্ক করে দিচ্ছেন যাত্রীদের। তাঁরা এবার সমবেত কণ্ঠে গাইলেন নজরুলের গান। এক এক করে আসে আমাদের পেছনের ইতিহাস। কৃষ্টি, সংস্কৃতি—আমাদের পরিচয়।

দর্শক শ্রোতার একাংশ
দর্শক শ্রোতার একাংশ

প্রতিকূল অবস্থা। নৌকা দুলছে, জল ফুলে উঠছে, মাঝি পথ ভুলে বসেছে। এমন একটা কঠিন সময়ে পাল ছিঁড়ে গেছে। কার এমন হিম্মত আছে এমন বিপদে হাল ধরবার। নজরুল আহ্বান জানিয়েছেন ঝঞ্ঝাপূর্ণ এই অবস্থায় দায়িত্ব নিতে।
১১ মে শুক্রবার সন্ধ্যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী পালন করা হলো। বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজন করে এ অনুষ্ঠানের। সেখানে বাংলাদেশ স্কুলও অংশগ্রহণ করে। স্থানটি ছিল প্রবাসের পুণ্যভূমি স্কুল অডিটোরিয়াম। এই অনুষ্ঠানে দূতাবাস ও স্কুল পরিবার ছাড়া অন্যরাও অংশ নেয়।
বিশ্বকবি ও জাতীয় কবি, দুজনের জন্মজয়ন্তী তাঁদের গান, কবিতা দিয়ে সাজানো হলো। তাঁদের সৃষ্টি দিয়ে তাদেরই স্মরণ। দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান ঠিকই বলেছেন, গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা করছি। তিনি বলেন, আয়োজন ছোটও হতে পারে, তাতে ক্ষতি কী! গুণগতমান যাতে অক্ষুণ্ন থাকে সেদিকেই নজর রাখতে হয়।

দর্শক শ্রোতার একাংশ
দর্শক শ্রোতার একাংশ

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতির মনন তৈরি করে গেছেন। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা তাঁর রচনা থেকে জাতীয় সংগীত গ্রহণ করেছে। নজরুল বেশি দিন লিখতে পারেননি। তবে তিনি তাঁর স্বল্প সময়ে আমাদের দিয়ে গেছেন অনেক। রাষ্ট্রদূত প্রধান বক্তা ছিলেন সেদিন। অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রনাথের এক গাঁয়ে কবিতাটি পড়ে শোনান। ...আমরা দু'জন একটি গাঁয়ে থাকি/ সে আমাদের একটিমাত্র সুখ।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা কথা বলাই যায়। যেদিন কবিগুরুর আগমন ঘটেছিল উদাত্ত এই ধরনীর বুকে, দুই বাংলার অস্তিত্বে জেগেছিল নবপ্রাণের স্পন্দন। অন্যদিকে নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা মুক্তি ও বিদ্রোহ। নজরুলের গান তাই আমাদের যেমন আনন্দে আন্দোলিত করে তেমনি জোগায় অনন্ত প্রেরণা।

দর্শক শ্রোতার একাংশ
দর্শক শ্রোতার একাংশ

অনুষ্ঠানে আবুধাবির বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বক্তব্য রাখেন। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং লালনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বলেন, চর্চার মধ্য দিয়ে এই বৃত্তিগুলো জাগ্রত রাখা প্রয়োজন। তিনি তাঁর ছাত্রজীবনে সাহিত্য চর্চায় শিক্ষকদের ভূমিকা তুলে ধরেন। তাঁদের ছিল সাহিত্য সংস্কৃতির ওপর প্রবল দখল। তিনি বলেন, শিক্ষকেরা এই দায়িত্বটা পালন করতে পারেন সহজেই। তিনি বাংলা ভাষা, এর পরিমার্জিত ও আঞ্চলিক রূপের সংরক্ষণে বিশেষ জোর দেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। তিনি দুই কবির প্রতি প্রাণের আকুতি প্রকাশ করেন। তাঁর সংস্কৃতি ভাবনারও একটি চিত্র তুলে ধরেন। বলেন, আমরা যা দেখি যা করি তাই-ই সংস্কৃতি। বাল্যবন্ধু রীনার ভোরের চর্চা ছিল, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে’ অথবা ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া।’ ওদিকে ফজরের নামাজ শেষে মুসল্লিরা প্রভাতের পরশ নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধরে এগোচ্ছেন। তাঁরা হিন্দু-মুসলমানের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে শুরু করেছেন দিনের কর্মযজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের শিক্ষা এটাই। সমাজের অসাম্য সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতা, অন্যায় ও অবিচার দূর করতে তাঁরা তরুণ সমাজকে প্রাণ দিয়েছেন। জ্বলে ওঠার সাহস জুগিয়েছেন।

দর্শক শ্রোতার একাংশ
দর্শক শ্রোতার একাংশ

প্রবাসে বাংলাদেশ দূতাবাস শিশু-কিশোরদের মধ্যে বাংলা ভাষা, কৃষ্টি এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে যত্নবান। অনুষ্ঠানের সঞ্চালকই বলছিলেন। আজকের আয়োজনও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ‘কুলিমজুর’ কবিতা পড়া হয় সেখানে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ড. মোহাম্মদ মোকসেদ আলী।
গ্রামবাংলা ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। প্রকৃতির অপরূপ এক নান্দনিকতায় কবিগুরু নিজেকে সঁপে দিতেন কখনো। ছয় ঋতুর বৈচিত্র্য নিয়ে তাঁর আবেগ আর অনুভূতির শেষ ছিল না। প্রিয় ঋতু বর্ষাকে নানাভাবে বর্ণনা করেছেন নিজের লেখা কবিতা ও গানে। নৃত্যে সংযোজন করা হয় বিখ্যাত এক গান। ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’। এ গানে নাচে আরশি, তানহা ও মন্টি। এরপর একপর্যায়ে দেখি, বসন্তের নির্বাচন। সঙ্গে নাচে দুই শিশু। আনিশা ও আশফি। নৃত্যটি পরিচালনা করেছেন আজমেরী শেলি।
আনন্দের অবগাহনে মন তার হারিয়ে যায়। কোনো বাধা নেই সেখানে। তাইতো অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় জনপ্রিয় এক গান। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে... । নিধি গেয়ে শোনায় গানটি। চমৎকার তাল লয়, মিষ্টি কণ্ঠ মিষ্টি মেয়ের! এইভাবে প্রকৃতি প্রেম, মানব প্রেম, স্বদেশ প্রেমে অভিষিক্ত কবিগুরুর গান। কখনো গানে কখনোবা নৃত্যের তালে সেসব উপলব্ধি করতে পারেন দর্শক। জাগরণের উৎসাহ তাঁর লেখায়। অনুষ্ঠানে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পড়া হয়। পড়ে উমামা।

শিশু শিল্পীরা
শিশু শিল্পীরা

নজরুল বিদ্রোহের কবি, প্রেমেরও। সাড়ে তিন হাজার গান লিখেছেন। এমন গানের সঙ্গে নাচে শিশুরা। তারা প্রশংসা কুড়ায়।
‘যায় ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে’...নজরুলসংগীতের সঙ্গে নাচে রাবেয়া নুর।
এরও আগে আরও একটি নৃত্য ছিল মঞ্চে।
মেহরিন, সেহরিশ ও আরিশা নাচে। নৃত্যটি পরিচালনা করেন ফারজানা করিম এ্যানি।
সাম্য ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার, এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও সৃজনশীল কর্ম আমাদের নিয়ে যায় নতুন বাঁকে। কবির ক্ষুরধার অগ্নিঝরা লেখনী শোষিত-নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে মানুষকে সোচ্চার করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিক্ষা দেয়। কবি ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান গেয়েছেন, নারীর অধিকারকে সমুন্নত করেছেন।
রবীন্দ্র-নজরুল নিয়েই আলোচনা। বাংলাদেশ স্কুলের উপাধ্যক্ষ কাজী আবদুর রহিম। বলেন, রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ের কবি। তাঁকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কবিগুরু জুড়ে আছেন আমাদের সত্তা। নজরুল সম্পর্কে বলেন, এক হাতে তাঁর রণতূর্য, বিদ্রোহী কবি তিনি। অন্যদিকে প্রেমকে দিয়েছেন প্রগাঢ় মর্যাদা। আরেক উপাধ্যক্ষ মোখলেসুর রহমান বলেন, রবীন্দ্র-নজরুল চেতনায় আমরা দীক্ষিত। সে চেতনা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা সেটাই করছি। আমাদের সার্থকতাও সেখানে। তৃপ্তিও।

সেলফি তোলায় ব্যস্ত কয়েকজন
সেলফি তোলায় ব্যস্ত কয়েকজন

অনুষ্ঠান সম্পর্কে মতামত দিলেন শ্রোতা-দর্শক। অধ্যাপক আবু তাহের প্রথম সারিতে বসা ছিলেন। দেখলাম উপভোগ করছেন অনুষ্ঠান। প্রকাশ তাঁর ভালো লাগার। শহিদুল হক খান। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আছেন বরাবর। তিনি কথা বলেন শব্দ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁর। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। আমি শুনছি। ওমর ফারুক-সুমাইয়া দম্পতি। দুই সন্তান নিয়ে এসেছেন তাঁরা। বললেন, সময়টা ভালোই কাটল।
আবদুস সামাদ আর রোকশানা বেগম। একপাশে দাঁড়িয়ে তখন। ছেলেমেয়ে তাঁদের বড় হয়ে উঠেছে। ছেলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। মেয়ে বাইও কেমিস্ট্রি পড়ছে। একেবারে ছোট সন্তান মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত। বললেন তাঁরা। এখন একটু সময় পাই বাইরে আসতে। চমৎকার তাদের অনুভূতি, সুন্দর আয়োজন! ফজলে এলাহি-এ্যানি দম্পতি সরাসরি যুক্ত অনুষ্ঠানে। তাঁদের কন্যা নেচেছে লাল টুক টুক বউ যায় গো। মুগ্ধতার চিহ্ন দুজনের মুখে।
ছবিও অনুষ্ঠানের আরেক আকর্ষণ। গান গেয়েছেন মঞ্চে সে এক কৃতিত্ব। তবে আনন্দ যত আলোকচিত্রে। তাহমিনা রিক্তা সেলফি তুলছেন। সঙ্গে আছেন তাঁর সখীরা। আসমা সুলতানা, কারিশমা এনাম, মৈত্রী বড়ুয়া, বসে থাকেন না। এলি হাসান, সাইফুন নাহার জলি, হাসিনা আজিজ আছেন সে দলে। ক্যামেরা জ্বলে ওঠে। আলোর ঝিলিকে হেসে ওঠে সবার মুখ।
সমবেত গানে তিনিই নেতৃত্ব দেন। আঞ্জুমান আরা খান শিল্পী। তিনি পরে গাইলেন রবীন্দ্রসংগীত। সখী ভাবনা কাহারে বলে। অনুষ্ঠান শেষে গান নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা। দেশের গান গেয়ে থাকেন। এর আগে একটা অনুষ্ঠানে দেখলাম নজরুলসংগীত গাইতে। আজ করলেন রবীন্দ্রসংগীত। তিনি বলেন, নজরুল তাঁর সৃষ্টির প্রেরণাটুকু আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন। রবি ঠাকুর, তাঁরও শিক্ষা, কাজের কাজটি করো। তাঁর লেখা ছাড়া কি এগোনো যায়?
আমার হৃদয়ে বেজে ওঠে, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।...সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও।
অতঃপর আমিও ছুটি এই মন্ত্র নিয়ে।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।