ক্যানবেরায় পঞ্চকবির গান

অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পীরা
অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করছেন শিল্পীরা

প্রবাসের যান্ত্রিক একঘেয়েমি জীবনের মাঝে বাঙালিরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। আর এই ব্যস্ত থাকার উপকরণ যদি হয় সংগীত, তাহলে ক্যানবেরার সংগীতপ্রেমীদের জন্য সেটা একটি বিশেষ দিন। সেই সূত্রে গত শনিবার (১২ মে) স্পন্দন সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত পঞ্চকবির গান অনুষ্ঠানের জন্য ক্যানবেরায় ছিল একটি বিশেষ দিন। নিজেকে সংগীতপ্রেমী না ভাবলেও গান শুনতে আমার সব সময় ভালোই লাগে। আর তাই অন্য অনেকের মতো পরিবার নিয়ে হাজির ছিলাম অনুষ্ঠান দেখতে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভেবেছিলাম দর্শক কম হবে, কিন্তু ভেতরে গিয়ে পেছনের সারিতে জায়গা নিতে হলো অনেক দর্শকের উপস্থিতির কারণে।

নির্ধারিত সময়ের একটু পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’ সমবেত কণ্ঠে পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে পঞ্চকবি নিয়ে স্পন্দন তাদের আয়োজন শুরু করে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য’ গানের দ্বিতীয় পরিবেশনার পর অনুষ্ঠান সঞ্চালক সাফকাত জামান রূপম, শারমিন আজিজ শম্পা ও ফাহমিদা সোমা ক্যানবেরার আদিবাসী ও দেশকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অনুষ্ঠানের শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সমবেত পরিবেশনায় ছিলেন লুনা, তৃনা, শুক্তি, এলি, রানা, রুপা, আশরাফ, সামসুল হুদা, কামাল উদ্দিন, খন্দকার ইউসুফ, তারেক সাফা ও অমিত। তবলাতে সজীব, বেস গিটারে শুভ ও কিবোর্ডে আতিক হেলাল অনুষ্ঠান উপভোগের মাত্রা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ওঠো ওঠো রে’, ‘লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’, ‘আজি প্রণমি তোমারে’, কাজী নজরুলের ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ‘জাগো অনশন বন্দী’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বেলা বয়ে যায়’, ‘আজি নুতন রতনে’, রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’, ‘তুমি নির্মল কর’, অতুল প্রসাদের ‘জল বলে চল’ গানগুলো সমবেত কণ্ঠের পরিবেশনা ছিল উপভোগ করার মতো।
স্পন্দন সাংস্কৃতিক সংগঠনের এই আয়োজন ক্যানবেরার দর্শকদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পঞ্চকবি নিয়ে এই আকারের আয়োজন ক্যানবেরাতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কোথাও ঘরোয়াভাবে যদি হয়ে থাকে সেটি ভিন্ন। প্রবাসে আমরা যারা দেশের মূল সংস্কৃতির সঙ্গে প্রধানত ইন্টারনেট টেলিভিশনের মাধ্যমে যুক্ত, তারা রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতি ছাড়া অতুল প্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত এদের গান শোনার সুযোগ খুবই কম পাই। বাণিজ্যিকীকরণ শিল্প সংস্কৃতিকেও সমানভাবে গ্রাস করেছে। স্পন্দন আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে তাদের এই আয়োজনের মাধ্যমে। আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে স্পন্দনের শিল্পীরা। আমরা যারা ক্যানবেরায় থাকি তারা জানি স্পন্দনের শিল্পীরা পেশাদার শিল্পী নয়। এঁরা কেউই পুরস্কার কিংবা তারকা হওয়ার জন্য গান করেন না। গানের প্রতি এঁদের ভালোবাসা এতটাই যে অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে একজনের হার্ট সার্জারি ও অন্য দুজন শিল্পীর শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানের আগে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া অনুষ্ঠানের পরিবেশনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। এই গান পাগল মানুষগুলো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা এখানে বেড়ে উঠছে তাদের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকবে।
পঞ্চকবির অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর অতুল প্রসাদ এঁদের অনেক ভালো ভালো কিছু গান শোনার সুযোগ হয়েছে। অনুষ্ঠানের গান নির্বাচন অবশ্যই একটি বিশেষ দক্ষতা ও দলনেতা হিসেবে লুনা সেই দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে করেছেন সেটা শিল্পীদের পরিবেশনা দেখে বোঝা গেছে। অনুষ্ঠানে লুনার কণ্ঠে রজনীকান্ত সেনের ‘আমি অকৃতী অধম’ কিংবা তৃনার কণ্ঠে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আমরা মলয় বাতাসে’ কিংবা ফাহমিদা সোমার কণ্ঠে ‘যদি তোর হৃদ যমুনায়’ এবং তারেক সাফার কণ্ঠে ‘আজি এসেছি আজি এসেছি’ গানগুলো এখনো কানে বাজে। প্রতিটি গান পরিবেশনের সময় পর্দায় কবিদের ছবি এবং গানের পরিচিতি প্রদর্শনের আয়োজন ভালো লেগেছে। সেই সঙ্গে শিল্পীদের গরদের লাল সাদা শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরিধান অনুষ্ঠানকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে। ক্যানবেরাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো আমাদের সকলের সহযোগিতা করা উচিত। নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি বৃহত্তর কমিউনিটি আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারলেই বাঙালি হিসেবে আমরা নিজেদের গর্বিত ভাবতে পারব।
গানের প্রতি ভালোবাসা থেকে ২০০৬ সালে স্পন্দন গঠিত হলেও মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং বাংলা কৃষ্টিকে প্রবাসে ধরে রাখার চেষ্টা স্পন্দন সব সময় করে যাচ্ছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত সবগুলো আয়োজনের উপার্জিত অর্থ বাংলাদেশের দুস্থদের সাহায্যে ব্যয় করেছে। কিছু ছোটখাটো ভুল ত্রুটি এবং মাঝে মাঝে হারমোনিয়ামের শব্দ অন্য যন্ত্রকে ছাপিয়ে যাওয়া বাদ দিলে পঞ্চকবির গানের এই আয়োজন দর্শক হিসেবে আমার ভালো লেগেছে। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য স্পন্দনের বর্তমান সভাপতি জামির হোসেন অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। এ ছাড়া এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য পেছনে থেকে যারা শব্দ ও আলো নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছেন তাদের জন্য দর্শকদের পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ। পরিশেষে স্পন্দনের কাছ থেকে আমরা এ রকম আরও পরিবেশনা উপভোগ করতে পারব এই আশা করছি। যারা অনুষ্ঠানটি দেখতে পারেননি তাদের জন্য নিচে ইউটিউব এর ভিডিও লিংক দেয়া হলো।

নিউটন দেবু: অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাপ্রবাসী। লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

<https://youtu.be/hnpidYBKB0k>
<https://youtu.be/s1hdP9hqkng>
<https://youtu.be/UMgpuW61edw>