বিনি সুতার বাঁধন

স্কুলজীবনের সেই বন্ধুর সঙ্গে লেখক। ২০০৫ সালে তোলা ছবি
স্কুলজীবনের সেই বন্ধুর সঙ্গে লেখক। ২০০৫ সালে তোলা ছবি

আমার শৈশবের পরিবেশটা ছিল পুরোপুরি আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত। আশপাশের সবাই কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কে আত্মীয় ছিল। সকলকেই আমি চিনতাম খুব ছোটবেলা থেকেই। তাই কোনো অপরিচিত বা অচেনা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে হয় বা কী নামে ডাকা হয় সে সম্বন্ধে তেমন ধারণা ছিল না। এভাবেই আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমার গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে শহরতলিতে আমাদের নতুন বাড়িতে আসি। এসে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

আমার যত দুর মনে পড়ে আমার রোল নম্বর ছিল ২৫। ওই দিন বা আগের দিন আরেক ছেলে ভর্তি হয়েছিল। তার রোল নম্বর ছিল ২৪। ক্লাসে প্রথম দিনই পরিচয় হলো সবার সঙ্গে। ওই ছেলেটা ছিল একটু রাশভারী টাইপের। তাই খুব বেশি আলাপ হলো না। কিন্তু অন্য অনেকের সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল। মানে আমিতো এসেছি পদ্মার ওপার থেকে। তাই আমি সবার জন্য একটা মজার বিষয়ে পরিণত হলাম।

হাইস্কুলটা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। প্রায় কিলোখানিক হাঁটার পর আমাদের গ্রাম বাড়াদি ছেড়ে জগতিতে আসতে হতো ছোট একটা নদী পার হয়ে। ওটা আসলে একটা খাল ছিল। কুষ্টিয়া চিনিকলের বর্জ্য গড়াই নদীতে নিষ্কাশনের জন্য ওই খাল তৈরি করা হয়েছিল। আর বর্ষাকালে ওই খাল দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হয়ে আশপাশের এলাকার সেচের সুবিধা করে দিত। ওটার ওপর ছিল বাঁশের তৈরি সাঁকো। যেটা পার হতে শুরুর দিকে আমার খুবই ভয় করত। কিন্তু পরের দিকে একেবারে ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছিল। সাঁকোটা পার হয়েই যেখানে জগতির হাট বসত সেখানে অন্য দিকে থেকে আরও একটা রাস্তা এসে মিলে একটা রাস্তা হয়ে আমাদের স্কুলের দিকে চলে গিয়েছে।

স্কুলে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দিন। আমি সাঁকোটা পার হয়ে জগতি হাটের ওপর দিয়ে হেঁটে স্কুলের দিকে যাচ্ছি। দেখি অন্য রাস্তাটা দিয়ে সেই রাশভারী ছেলেটা একটা সাইকেল চালিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই বলল, সাইকেলে উঠে পড়। জানালাম আমি তো সাইকেলে চড়তে জানি না আর কীভাবে চালাতে হয় তাও জানি না। ছেলেটি বলল, সমস্যা নাই, আমি দেখিয়ে দেব। আমি যেহেতু লাফ দিয়ে সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে চড়তে পারব না, তাই আমি সিটের সামনে সাইকেলের রডে চড়ে বসলাম। স্কুল থেকে ফেরার পথেও একইভাবে ফিরতাম আমরা। যে জায়গা থেকে সাইকেলে উঠতাম আবার সেই একই জায়গাতে আসার সময় নামতাম। ধীরে ধীরে এটা আমাদের প্রতিদিনকার রুটিনে পরিণত হলো। এ ছাড়া আমরা একই স্যারের কাছে একই ব্যাচে পড়ার সুবাদে ঠিক একইভাবে আসা যাওয়া করতাম। এভাবেই চলেছিল এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত।

এর মধ্যে ক্লাসের অন্য একটা ছেলে গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার কেন জানি ভালো লাগত না। সে আমার বাড়িতে এসে আমাকে ফুলের গাছও উপহার দিয়েছিল। তার গোলাপ গাছের প্রথম গোলাপ ফুলের বীজটা পর্যন্ত আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তারপর তার বাড়িতে আমাকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিল। তার মা আমাকে অনেক আদর করে ডিম পোচ করে খাওয়ালেন। জীবনে প্রথম ডিম পোচ খাই আমি তাদের বাসায়। কিন্তু এর কোনো কিছুই আমাকে বশে আনতে পারেনি। তাই তার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের বন্ধুত্বটা আর হয়ে ওঠেনি। একদিন তার মায়ের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, তোমাকে কত আদর করলাম আর তুমি আমাদের বাসাতেই আর গেলা না। আমি কিছু বলিনি, কারণ আমার কেন জানি ভালো লাগত না। আগের ছেলেটার সঙ্গে আমার অজান্তেই একটা বোঝাবুঝির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেটাকে বন্ধুত্বই বলা যায়। যদিও এটা আমার জন্য খুবই লাভজনক একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার তেমন কোনো কাজে আমি কখনোই আসতে পারিনি। আজ সে গল্পই বলব আপনাদের।

আমি বরাবরই ক্লাসে দ্বিতীয় হতাম আর সে হতো তৃতীয়। এর একটা সহজ সূত্র ছিল। যেটা আমরা প্রথন তিনজনই জানতাম। ব্যাপারটা ছিল পরীক্ষার হলে আমি তার খাতা দেখে লিখতাম আর তার সঙ্গে আমার উর্বর মস্তিষ্ক খাঁটিয়ে আরও কিছু যোগ করে দিতাম। তাই আমার উত্তরটা তার চেয়ে ভালো হতো এবং আমি তার চেয়ে বেশি নম্বর পেতাম। আবার আমার খাতা দেখে লিখত প্রথমজন। এরফলে সে আবার আমার চেয়ে বেশি নম্বর পেত। এভাবেই সে হতো তৃতীয়, আমি দ্বিতীয় আর অন্যজন হতো প্রথম। আমার কখনোই মনে প্রশ্ন জাগত না যে, ওকেও তো একটু দেখানো দরকার। পরে চিন্তা করতাম আরে ও না পারলেতো বলবে। যদিও সে সেটা কখনই বলেনি আর আমিও তার জন্য কখনোই কিছু করতে পারিনি।

আসলে পৃথিবীতে একেবারে সামান্য কিছু মানুষ আছে যারা এমন চরিত্রের অধিকারী হন। যারা প্রতিদানের আশায় কারও উপকার করেন না। উল্টো আমি আবার কেমন কৃতঘ্ন ছিলাম সেটা বলি। আমরা একই স্যারের কাছে অঙ্ক পড়তাম। স্যার অনেক পরীক্ষা নিতেন। সাপ্তাহিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। সোজা কথায় পরীক্ষা লেগেই থাকত। আর প্রতি পরীক্ষাতেই কিছু না কিছু পুরস্কার থাকত, যেটা পরীক্ষা দেওয়ার প্রতি আমাদের আগ্রহী করে তুলত। এসএসসি পরীক্ষার আগ দিয়ে স্যার একটা মডেল টেস্ট নিয়েছিলেন। সেটাতে প্রথম পুরস্কার ছিল জয় পকেট ডিকশনারি। সেই মডেল টেস্টেও প্রথম হয়েছিল। তখন আমিতো হিংসায় তার খাতা দেখে ভুল খুঁজে বের করা শুরু করলাম। আর স্যারকে বললাম, ওরতো এটা হয় নাই, ওটা ভুল হয়েছে। চিন্তা করেন আমি নিজের ভুল না ঠিক করে অন্যজনের ভুল খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাও এমন একজনের, যে কোনো প্রতিদান ছাড়ায় প্রতিনিয়ত আমার উপকার করে যাচ্ছে। এসএসসি পাশের পর আমি যেহেতু একটু বেশি নম্বর পেলাম তাই আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে প্রথমবারেই চান্স পেয়ে গেলাম। কিন্তু সে প্রথমবারে চান্স পেল না। আমি সেটার খোঁজ তো রাখিইনি বরং আমি আমার ভর্তি বিষয়ক কাজকর্ম নিয়ে স্বার্থপরের মতো ব্যস্ত হয়ে গেলাম। পরবর্তীতে সিটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলে সে অবশ্য চান্স পেয়েছিল।

কলেজজীবন শুরু হয়ে গেল দ্রুতই। যেহেতু শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে কলেজ আবার একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছিল তাই রাজনৈতিক ও অন্যান্য নানা কারণে আমাদের ক্লাস হতো খুবই সামান্য। এ জন্য প্রাইভেট পড়া একেবারে অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। আমাদের কলেজজীবনের যে বন্ধুত্বের সার্কেল তৈরি হয়েছিল সেটা ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সব স্যারদের ব্যাচ নির্ভর। আর কলেজটা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তাই কলেজে ক্লাস করে আবার স্যারদের কাছে বিভিন্ন ব্যাচে পড়তে যাওয়ার জন্য সাইকেলটা একেবারে জরুরি হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া তখন সে আর ছিল না।

আমি ভর্তি হয়েছিোম এ সেকশনে। আর সে ভর্তি হয়েছিল বি সেকশনে। অনেক কষ্টে টাকা পয়সা জোগাড় করে যত দুর মনে পড়ে মাত্র ৭৫০ টাকা দিয়ে মা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিলেন। সেটাকে অবশ্য সবাই সাইকেল বলত না। কেউ বলত হোন্ডা, কেউ বলত হেলিকপ্টার, কেউ বলত উড়োজাহাজ ইত্যাদি। যা হোক, আমি সাইকেলের দোকানে গিয়ে একটা সাইকেল কিনে কোনোমতে ঠেলতে ঠেলতে সেটাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। কারণ আমি তখন পর্যন্ত সাইকেল চালাতে জানি না।

এখন উপায় কি হবে? যথারীতি সেই এগিয়ে এল আমার উপকার করতে। আমরা একেবারে রুটিন করে কুষ্টিয়া জেলা স্টেডিয়ামে গিয়ে সাইকেল চালানো শেখা শুরু করলাম। প্রক্রিয়াটা ছিল বেশ জটিল ও হাস্যকর। স্টেডিয়ামের গোল পোস্টের কাছে সাইকেল দাঁড় করিয়ে আমি সাইকেলে উঠতাম। তারপর সে সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ার ধরে সাইকেলটাকে সোজা করে রাখত আর আমি প্যাডেল ঘোরাতে থাকতাম। আমার জন্য ব্যাপারটা ছিল একেবারেই জটিল ও কঠিন। আর যেহেতু অন্য আরেকজন সমবয়সী ছেলেই সাইকেলটা ধরে সোজা করে রাখছে তাই ব্যাপারটা দেখেতে হাস্যকর ছিল।

স্কুলজীবনের সেই বন্ধু ও অন্য আরেকজনের সঙ্গে লেখক
স্কুলজীবনের সেই বন্ধু ও অন্য আরেকজনের সঙ্গে লেখক

এভাবে প্রায় সপ্তাহখানিক চালানোর পর আমি আমার হেলিকপ্টার রাস্তায় নামিয়ে ছিলাম। আমি এখন পর্যন্ত আগে সাইকেলের সিটে বসি তারপর সাইকেল চালাই। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে সবাই আগে সাইকেলটা চালায় তারপর লাফ দিয়ে সিটে উঠে বসে। এই সাইকেল চালানো শেখা আমার জীবনের অন্যতম দুঃসাহসী ঘটনা ছিল। এরপর আমি আর সে মোটামুটি প্রায় সব বিষয়ই একই স্যারের কাছে একই ব্যাচে পড়েছিলাম। আমি আমার বাড়ি থেকে একটু আগে বের হয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তারপর একসঙ্গে আমরা স্যারদের বাসার উদ্দেশে রওনা দিতাম এবং এই হেলিকপ্টারে চড়েই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসী ঘটনাটাও ঘটিয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত আমার প্রথম ও শেষ প্রেমিকার বাসায় ক্রিকেট বলের গতিতে গিয়ে তার মায়ের হাতের ব্যাটে মার খেয়ে বাউন্ডারির বাইরে চলে গিয়েছিলাম।

কলেজ লাইফের শেষ পর্যায়ে টেস্ট পরীক্ষায় নোটিশ বোর্ডে নাম ওঠায় আমি মোটামুটি কলেজে বিখ্যাত হয়ে গেলাম। এরপর এইচএসসিতে একটু ভালো রেজাল্ট করার পর কলেজের অনেক সহপাঠী মৌমাছির মতো আমার চারপাশে ভিড় জমানো শুরু করল। তারা আমাকে আগেভাগেই বুকিং করে ফেলল কার জন্য কোথায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দিতে হবে। আমি জীবনের প্রথম ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম অন্য মানুষের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সে। যার হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম সে চান্সও পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কী এক ঝামেলার কারণে তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল এবং তাঁর ধারণা ছিল ঝামেলাটা আমিই পাকিয়েছি। তাই আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আর খুব বেশি মজবুত হয় নাই। পরে অবশ্য সে কুয়েটে সিভিলে চান্স পেয়েছিল এবং একসময় একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে আমার সিনিয়র ছিল। এ ছাড়াও মেডিকেল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক জায়গায় অন্যের জন্য আমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। কিন্তু একবারের জন্যও আমার স্কুলজীবনের বন্ধুর কথা মনে হয়নি।

আমার এখনো মনে হয় আমি যদি তার জন্য কোনো এক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দিতাম তাহলে সে অনেক ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো কোনো বিষয়ে পড়তে পারত। পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষায় আমার অবশ্যম্ভাবী ভালো করার বিষয়টা অনেকের ব্যবসার পুঁজি হয়ে গিয়েছিল। আমি বুয়েট লাইফ শেষ করেও অনেকের জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম বিভিন্ন জায়গায় তাদের চান্স পাইয়ে দেওয়ার জন্য। এমনকি আমার বুয়েট লাইফ শেষ হওয়ার আগেই অনেককে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় চান্স পাইয়ে দিয়েছিলাম। আমি এই কথাগুলো বলছি কাউকে খাটো করা বা ক্রেডিট নেওয়ার জন্য নয়। আমি বোঝাতে চাইছি দুই দিনের পরিচিত মানুষদের জন্য আমি কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলাম। কিন্তু যে সারা ছাত্রজীবন আমার উপকার করে গেল তাঁর কোনো কাজে সাহায্য করিনি। আরও একটা ব্যাপার ভুলে গিয়েছিলাম সেটা হচ্ছে তার প্রায় সব বইই থাকত আমার কাছে। আমি যেহেতু সব বই সময়মতো কিনতে পারতাম না তাই তার বই নিয়ে পড়া তৈরি করতাম। যার ফলে সে সঠিক সময়ে সঠিক পড়াটা তৈরি করতে পারত না। এটাও তার রেজাল্ট খুব বেশি ভালো না হওয়ার পেছনে একটা কারণ বলে আমার বিশ্বাস।

এতো গেল ছাত্রজীবনের কথা। কর্মজীবনে এসেও আমি আমার সেই কৃতঘ্ন স্বভাব থেকে বের হতে পারিনি। তাই আমার বিয়ের আকদে উপস্থিত থাকলেও আমার বিয়ে পরবর্তী সংবর্ধনাতে সে উপস্থিত ছিল না। আর আমি জীবনে ভুলের শেষ পেরেকটা ঠুকেছিলাম তার বিয়েতে না গিয়ে। এরপর আর আমাদের সম্পর্ক কখনই আগের মতো প্রাণবন্ত ও স্বাভাবিক থাকল না। থাকবেই বা কীভাবে? একটা মানুষের সহ্যেরও তো একটা সীমা থাকে? আমি সেই ক্লাস সিক্স থেকে এইভাবে তাকে ঠকিয়ে আসছি আর সে মুখ বুজে সহ্য করে এসেছে। বুয়েট লাইফ ও পরবর্তীতে কর্মজীবনে অনেক ভালো বন্ধু পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্বার্থপর ও করপোরেট বন্ধুও পেয়েছিলাম। যাদের কারও কাছে আমি ব্যবসায়িক পুঁজি, কারও কাছে ছিলাম বিনোদন বা হাসির পাত্র। আবার কত মুখ সহজেই অচেনা হয়ে গেল, কি কারণে তা ওপরওয়ালায় ভালো জানেন।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি কৃতঘ্ন হলেও আমার অবচেতন মন সেই মানুষটাকে কোথায় যেন বসিয়ে রেখেছিল। সেটা টের পেয়েছিলাম তার সঙ্গে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর। প্রায় রাতেই আমি হঠাৎ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠতাম আর কাঁদতাম একেবারে ছেলেমানুষের মতো। আমার পাশে শুয়ে থাকা বউ জেগে উঠে সভয়ে জিজ্ঞেস করত কি হয়েছে? প্রায় সময় আমি এটা-সেটা বলে পাশ কাটিয়ে যেতাম। কিন্তু শেষমেশ একদিন বলতেই হলো। আমার মনে হয় সেদিন বউ অনেক মন খারাপ করেছিল। কারণ একজন বিবাহিত মানুষের জীবনে স্ত্রীকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার কথা। পরে আমার বউই উদ্যোগী হয়ে আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমার হয়ে ওকালতি করেছিল। এ জন্য অন্তত তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়াও যায়। তবে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এখন আবার আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা আবার পুনঃস্থাপিত হয়েছে। যদিও এখন আর আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। কারণ এখন আমাদের দুজনেরই নিজেদের সংসার আছে এবং কর্মস্থলও আলাদা আলাদা শহরে। তাই আর আমরা সেভাবে নিজেদের সময় দিতে পারি না। তারপরও আমি মন থেকে সব সময় একটা দোয়াও করি, আমার স্কুল ও কলেজজীবনের এই বন্ধু যেখানেই থাকুক না কেন সংসার নিয়ে যেন সুখে থাকে। আর যে কথাটা তাঁকে কখনই বলা হয়নি সেটা হচ্ছে, সবকিছুর জন্য আমি আসলেই অনেক অনেক দুঃখিত। আমরা দুজন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমাদের এই বিনি সুতার বাঁধন কখনই ছিঁড়ে যাবে না।
মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।