ঘাম, শ্রম, কষ্ট, কিংবা দীর্ঘশ্বাসের গল্প

রিমি রুম্মান, নিউইয়র্ক
রিমি রুম্মান, নিউইয়র্ক

নিউইয়র্কে রাস্তার পাশে ভ্যানগাড়িতে ‘জায়রো’ নামের একটি জনপ্রিয় হালাল খাবার বিক্রি হয়। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে-ওখানে বাঙালি মালিকানাধীন এমন অনেক ভ্যানগাড়ি আছে, যেখানে সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করেন বাংলাদেশি যুবকেরা। চোখের সামনেই গরম-গরম বানিয়ে দেওয়া হয় পাঁচ ডলারের এই খাবারের বক্স।

গত সপ্তাহে দুপুরের কোনো একসময়ে খাবার অর্ডার দিয়ে অন্য অনেকের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তুমুল ব্যস্ততা কর্মজীবী যুবকটির। দ্রুততার সঙ্গে হাসিমুখে একে একে সবাইকে সিরিয়াল অনুযায়ী খাবার দিচ্ছিলেন। একদিকে রাইস কুকারে রাইস ঢেলে দিচ্ছেন। অন্যদিকে চিকেন, ওনিয়ন, গ্রিন পেপারস প্রোসেসিং করছেন গরম চুলায়। বোঝা যাচ্ছে কাজটুকু পরিশ্রমের হলেও তিনি আনন্দের সঙ্গেই করছেন। তা আরও উপভোগ্য হচ্ছে, টেপ রেকর্ডারে বাজা বাংলা গানের কারণে। নিজের কাজকে, চারপাশের পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলার এ যে মানসিকতা, বিষয়টি মুগ্ধ করে আমায়। যেহেতু আমার আগে অনেকেই সিরিয়ালে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, তাই আমি সবজি কেনার উদ্দেশে সুপার মার্কেটের দিকে ছুটছি। অনেক দূর পর্যন্ত যেতে যেতে শুনছিলাম রেকর্ডারে বেজে যাওয়া গান, ‘বুকেরও ভিতরে আন্ধার কুটিরে
তুমি ওগো চান্দেরও বাতি...
চোখেরও মণিতে শয়নে-স্বপনে
আছো তুমি দিবসও রাতি...’

গ্রোসারি সেরে আবারও সেই ভ্যানগাড়ির দিকে ফিরছি খাবার নিতে। খানিক দূর থেকেই কানে ভেসে আসে গান,

‘এপারে থাকিবোওওওও...
এপারে থাকিবো, ওপারে থাকিবো
যাবো না দূরে সরিয়া, বন্ধু পরজনমেও মরিয়া...।’

অসাধারণ সব রোমান্টিক বাংলা গান। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশে কঠোর পরিশ্রমী টগবগে এক যুবক সকাল থেকে রাত্রী অবধি হাসিমুখে কাজ করছেন দেশেরই গান শুনে, বিষয়টি চমৎকার। একরাশ ভালো লাগার আবেশ নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরি।

এই শহরে মা দিবস ছিল যেদিন, রাস্তার দুই ধারে ফুলের পসরা নিয়ে বসেছেন অনেক বিক্রেতা। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, নানান রকম ভিনদেশি মানুষজন ফুল কিনছেন মায়ের জন্য। মায়ের প্রতি এদিন সবার আবেগ-অনুভূতিতে যেন ভিন্নতা নেই। সর্বত্র উৎসবের পরিবেশ। রমজান উপলক্ষে কেনাকাটা করতে সেই বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় যাই। ‘জায়রো’ অর্ডার দিয়ে অপেক্ষমাণ অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি। সম্ভবত সবাই যুবকের প্রতিদিনের চেনাজানা ক্রেতা। কাজের ফাঁকে তিনি গল্প করছিলেন। একজন জানতে চাইলেন, ছুটি করেন কবে? খাবারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বিল নিতে নিতে বললেন, ছুটি নিয়া কী করব, পরিবার তো দেশে, তা ছাড়া এক দিন ছুটি করা মানে এক শ ডলার লস। তিনি আবার আপনমনে কাজ করে চলেছেন। চামচের টুংটাং শব্দ, ধোঁয়া ওঠা খাবার, প্যাকেটে নিচ্ছেন, ওপর সস দিয়ে অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছেন। বিল বুঝিয়ে দিয়ে আমি ফিরছি অদূরে পার্ক করা গাড়ির দিকে। ভ্যানগাড়িতে গান বেজে চলছে,

‘কত দিন দেহি না মায়ের মুখ
হুনি না সেই কোকিল নামের কালা পাহির গান
হায়রে পরান, হায়রে পরান...’

সেদিন আমরা অনেকেই যখন ফেসবুকে ছবি দিচ্ছিলাম, মাকে নিয়ে সুখের কিংবা দুঃখের স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন বিদেশ বিভুঁইয়ের ব্যস্ততম দিনে একজন প্রবাসী তাঁর কর্মব্যস্ত সময়ে নীরবে মায়ের গান শুনছেন, মাকে মনে করছেন। গান শুনতে শুনতে তিনি হয়তোবা স্মৃতির জানালা ধরে মায়ের কাছে ফিরবেন, পরিবারের কাছে ফিরবেন, কাস্টমারদের সামনে হাসির আড়ালে কান্না লুকাবেন। হয়তোবা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। একজন মানুষ, যার কিনা পরিবার কাছে নেই বলে ছুটির দিন কিংবা আনন্দময় ঘুরে বেড়ানোর দিন, অর্থহীন। সময় নষ্ট না করে বাড়তি উপার্জন এবং পরিবারকে অর্থ পাঠানোর মধ্যেই যার সব আনন্দ নিহিত। দূরের অস্তমিত সূর্যের মতো দিনভর আলো বিলিয়ে পড়ন্ত বেলায় নিজে ডুবে যাওয়া মানুষ। দেশে সেই মানুষটির পরিবার কিংবা প্রিয়জনেরা হয়তো কোনো দিনই জানবে না প্রাপ্ত ডলারের বিপরীতে লুকিয়ে থাকা ঘাম, শ্রম, কষ্ট কিংবা দীর্ঘশ্বাসের এই সব গল্প।

*রিমি রুম্মান, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র