স্মৃতির পাতায় কালবৈশাখী

মাহবুব মানিক
মাহবুব মানিক

আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের কথা৷ একবার বৈশাখের শুরুতে কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে মুকুল সংঘ নাট্যগোষ্ঠীর আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল৷

অনুষ্ঠান শুরু করে সবেমাত্র ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি গাওয়া হয়েছে, অমনি কালবৈশাখী এসে সব উড়িয়ে দিয়ে গেল৷ মঞ্চের বাঁশ ভেঙেচুরে একাকার৷ শামিয়ানার লাল-নীল-হলুদ কাপড় ছিঁড়ে-ফেঁড়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ল৷ কোথায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আর কোথায় সভাপতি! কারও কোনো খোঁজ নেই৷ ধুলাবালুতে মাখামাখি হয়ে যে যার মতো পালিয়ে চলে আসলাম বাসায়৷

দেশে এখন বৈশাখ মাস শেষের পথে৷ কাঠাল পাঁকা জ্যৈষ্ঠ মাস এসে গেছে। বাংলা মাসের আবহ এখন আমার শুধুই স্মৃতি৷ আমাদের দেশে বছর ঘুরে চৈত্র-বৈশাখ মাসের মূর্তিমান আতঙ্ক বলতেই কালবৈশাখী৷ যদিও ঝড়ের মুহূর্তগুলো থাকে রোমাঞ্চকর আবার ভয়ংকর ও বটে৷ তথাপি আতঙ্কিত মুহূর্তগুলো আমাদের মতো দেশ থেকে দূরে থাকা মানুষের কাছে যথেষ্ট স্মৃতিময় হয়ে ওঠে৷ টিভি বা পত্রিকায় যখন খবর পাই দেশে ঝড় উঠেছে; কষ্টই লাগে৷ ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে কষ্ট পাই৷ প্রবাসে বসে খুব অনুভব করি চিরচেনা সেই ফেলে আসা কালবৈশাখীর রোমাঞ্চিত মুহূর্তগুলো৷ ঝড় শেষে কাঁচা আমে গড়াগড়ি আমগাছের তলা আজ শুধুই স্মৃতি৷ দীর্ঘ চারটি বৈশাখী মৌসুম পেরিয়ে গিয়েছে, কালবৈশাখীর সঙ্গে দেখা হয়নি৷

জার্মানির এই কংক্রিটের শহরে মাঝেমধ্যে ঝড়বৃষ্টি হয় বটে। তবে তা কালবৈশাখীর কাছে পানসে মনে হয়৷ জার্মানির ঝড়ের হম্বিতম্বি নিতান্তই শিশুতুল্য কালবৈশাখীর কাছে৷

দেশে যখন কালবৈশাখী শুরু হয়, আমাদের ঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতিটাও হতো অন্য রকম মজার৷ চকচকে রোদ ঢেকে হঠাৎ করেই আকাশ কালো হয়ে যেত৷ যেনতেন কালো নয়, ঘন কুচকুচে৷ রাস্তার ছোট ছোট দোকানপাট বন্ধের সেকি প্রাণপণ চেষ্টা৷ পথে আটকে পড়া মানুষের দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি চলত নিরাপদ একটি আশ্রয়ের খোঁজে৷ ততক্ষণে ধুলামিশ্রিত ঝোড়ো বাতাসে মাথার চুলে ধুলার আস্তরণ পড়ে যেত৷ রিকশা-ভ্যানশূন্য হয়ে যেত প্রধান সড়ক৷ ছোট্ট চায়ের দোকানে ছাউনির টিন তখন অনিয়ত বাতাসে ঝনঝন করে কেঁপে কেঁপে উড়ে যাওয়ার চেষ্টায় মত্ত৷ রাস্তার ধুলাবালু তখন আমাদের মাথার চুল মাখিয়ে শূন্যে দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রস্তুত৷ শন শন করে ছুটে চলত একমুখী বিক্ষিপ্ত বাতাস৷ রাস্তায় ততক্ষণে আমাদের ধুলাগোসল হয়ে যেত৷ চুলভর্তি ধুলা, জামার পকেটে ধুলা, চোখের মধ্যে ধুলার পরত৷ ঘরের বাইরে দড়িতে শুকাতে দেওয়া জামাকাপড় দমকা বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার৷ কোনোটা কারও ঘরের চালে, কোনোটা উড়ে গিয়ে পড়েছে পুকুরে৷ ঘরে ঘরে চলত জানালা-দরজা বন্ধের প্রস্তুতি৷ তা-ও উদ্ধত ধুলাবালু আটকে রাখা ছিল দুষ্কর৷ সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বাতাসের ছুটে চলার সেকি প্রাণবন্ত চেষ্টা৷ ভয়ংকর আর্তনাদে জানালার ফাঁকা জায়গাটুকুতে বেজে উঠত জেট প্লেনের মতো বাতাস কাটা শোঁ শোঁ শব্দ৷ গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিত৷ কিছুক্ষণ পরপরই বিকট শব্দ আর বিদ্যুতের আলোতে ঝলসে উঠত কালো আকাশ৷ হঠাৎ করেই ঝমঝম শব্দে মোটা মোটা বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে নামিয়ে দিত উড়ন্ত ধুলাবালু৷ একসময় শীতল বাতাসের শক্তির সাথে যোগ দিত বৃষ্টির শক্তি৷ শক্ত কাঠের জানালার ওপাশে তখন বৃষ্টি ফোঁটা আছড়ে পড়ার মুহুর্মুহু শব্দ৷ সব কাজ ফেলে আমাদের চলত প্রকৃতির তর্জন-গর্জন উপভোগ৷ ঘরে ঘরে তখন সৃষ্টিকর্তার নিকট নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা৷ মুহূর্তের মধ্যে ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ হয়ে যেত৷ গাঢ় অন্ধকার ঘরে সম্বল ছিল হারিকেন, কেরোসিনের বাতি বা কখনো মোমবাতি৷ উদ্যাম বাতাসে সে বাতির আলো আগলে রাখার অনর্থক চেষ্টা চলত আমাদের৷ ঘরের মেঝে তখন ধুলায় কিচকিচ করত৷ বিছানার চাদর, আলনার জামাকাপড় কোনো কিছুই রক্ষা পেত না ধুলাবালু থেকে৷ ভয়ংকর প্রকৃতি, ভয়ার্ত মানুষ ও ঘরহীন প্রাণী৷ পাখিবিহীন কালো আকাশ৷ অন্ধকার ঘর নামক ছোট্ট দুর্গে পরাজিত সৈন্যের মতো চুপসে বসে থাকতাম আমরা ক ভাইবোন ও বাবা-মা৷

আমাদের তিনতলা সরকারি কোয়ার্টারের পেছনেই কংক্রিটের প্রাচীরের ওপাশে চিকন খাল ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল বস্তি৷ ঝড়ের তাণ্ডবে বস্তির মাটি ও শণের ঘর থেকে প্রবল বাতাসের মাঝে শোনা যেত বিক্ষিপ্ত আর্তনাদ৷ কারও টিন উড়ে গিয়েছে কারও মাথার ওপরের শণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার৷ ঝোড়ো বৃষ্টিতে কারও মাটির দেয়াল গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া কোন দুর্গের মতো দেখাত৷ দোতলার বারান্দায় এসে অসহায় মানুষগুলোর প্রাণপণ ছোটাছুটি দেখতাম৷ সেকি তাদের অনর্থক চেষ্টা একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য৷ দৈত্যসমেত কালবৈশাখীর নিকট তারা নিজের সর্বস্ব প্রায় সমর্পণ করে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে৷ চারদিকে তখন গাছের ডাল পড়ার দুম-দাম শব্দ৷ দুর্বল গাছ উপজ়ে যেতো গোড়া থেকে৷ দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাছের ডাল এদিকে সেদিকে ছিটকে পড়ছে৷ কোনটা আবার বন্ধ জানালার ওপাশে এসে ঠাস আঘাত করতো৷ চমকে যেতাম সবাই৷ মস্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এত ভয়ঙ্কর মুহুর্তের স্বাক্ষী হতাম শুধুই আমরা৷

মাত্র এক ঘন্টা থেকে দুই ঘন্টা চলতো কালবৈশাখী ঝড়ের এই সাড়াশি অভিযান৷ পর মুহুর্তে ভেজা, শান্ত প্রকৃতি, চুপসে পড়া গাছ-পালা, লতা-পাতা, যেন কিছুই হয়নি প্রকৃতির৷ আমরা আতংকিত মানুষেরা ঘর হতে ছুটে ছুটে বের হয়ে আসতাম৷ চলে যেতাম আম গাছ তলায়৷ ছোট-বড় ফাটা আম যা পেতাম প্যান্টের পকেটে গুজে নিতাম৷ রাস্তার ধারে উল্টে পাল্টে পড়ে থাকতো গাছপালার ডাল ও বিদ্যুতের খুটি৷ বন্ধ রাস্তা ও বিদ্যুৎ তখন মেরামতের জন্য অপেক্ষারত৷ বিদ্যুৎ কখন ফিরবে কেউ জানেনা৷ হয়তো দুইঘন্টা বা দুই দিন৷ দুই ঘন্টা পরে যদি বা বিদ্যুৎ আসতো বিকট একটি শব্দে আবারও চলে যেত৷ বুঝে যেতাম ট্যানেসমিটার (ট্রান্সফরমার) বিষ্ফোরন ৷ বিদ্যুৎ তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতো দুই দিন বা তিন দিন পর৷

*মাহবুব মানিক, গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স হালে, জার্মানি