মেলবোর্নের ঘুমন্ত পাড়ায় একদিন
মেলবোর্নে আমার ঘোরাঘুরির একটা নিয়মিত জায়গা হলো শহরের নতুন-পুরোনো সেমিটারিগুলো। ছোটবেলা থেকে কবরস্থান নিয়ে গা ছমছমে নানান গল্প শুনে এসেছি। অথচ এই সেমিটারিগুলো দেখে আমার কখনই কোনো গা শিউরে অনুভূতি হয়নি। সাম্প্রতিককালে আমি দুটি সেমিটারি দেখে এসেছি। একটা হলো মেলবোর্ন জেনারেল সেমিটারি, অন্যটা শহরকেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের স্প্রিংভ্যাল বোটানিক্যাল সেমিটারি। প্রথমটা একটু জরাজীর্ণ, ১৮০০ শতাব্দী বা তারও পরের বিভিন্ন সময়ের মানুষের কবরে ঠাসাঠাসি অবস্থা প্রায়। আর পরেরটা একটা বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে ছবির মতো সাজানো-গোছানো বিরাট আয়তনের কবরখানা। এখানে বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের জন্য আলাদা জায়গা দেওয়া আছে।
আমি আগ্রহভরে ঘুরে ঘুরে প্রতিটা কবর দেখি, এপিটাফ পড়ার চেষ্টা করি। মানুষগুলো নেই কিন্তু তাঁদের নাম-পরিচয় আছে। একই কবরে পরিবারের অনেকেই আছে দেখলাম। সবচেয়ে অবাক লাগল যখন দেখলাম, স্বামী হয়তো মারা গিয়েছিলেন ৫০ বছর আগে, তাঁর স্ত্রীর কবর ও হয়েছে স্বামীর কবরে। আমি ভাবছিলাম, এ ৫০টি বছর একটা মানুষ কীভাবে সঙ্গী হারানোর বিরহ নিয়ে একা থাকলেন, যেখানে ইচ্ছা করলেই আরেকটা সঙ্গী জুটিয়ে নেওয়া এখানে কোনো ব্যাপারই নয়। আবার দেখলাম, সঙ্গীর মৃত্যুর পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেই অন্যজনের মৃত্যু হয়েছিল—দুজনই ঘুমিয়ে আছেন একই কবরে! কী অনন্ত প্রেম—আহা! এঁরা আসলেই একজনকে ছাড়া আরেকজন বাঁচে নেই, কেবল সিনেমাতেই ঘটে না তাহলে বিষয়টা!
খারাপ লাগল, যেখানে দেখলাম ভাইবোন বা সঙ্গী যুগলের মৃত্যুর তারিখ একই। এঁরা কোনো দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। যাঁরা গেছেন, তাঁরা হয়তো কবরে একসঙ্গে আছেন কিন্তু আমি ভাবছিলাম, তাঁদের পরিবারের অন্যদের জন্য এটা কী মর্মান্তিক একটা স্মৃতি! একই দিনে পরিবারের দুজনকে দুঃখজনকভাবে হারানো।
বাচ্চাদের কবরে দেখলাম পরির মূর্তি গড়া—ওদের বাবা-মা কবরের ওপরে যে এপিটাফ লিখে রেখেছেন, সেগুলো পড়ে বুকের গহিনে কান্না আসবে না, এমন মানুষ হয়তো নেই পৃথিবীতে।
কিছু কবর দেখলাম, ১৮৫৫ বা এরও আগের—এই শতাব্দীপ্রাচীন মানুষগুলো আমার আরেক আকর্ষণের বিষয়। আমি এদের কবরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, এদের সেই সময়কার জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ, ব্যক্তিজীবন। এঁদের কবরে এসে ফুল দেবে এমন একটা মানুষও মনে হয় জীবিত নেই। আমি তাই ঘাসফুল খুঁজে এনে এই প্রাচীন কবরগুলোই দিই আর মিছামিছি ভাবি—এই কবরে যে আছে, তাঁকে আমি চিনতাম, আমি কল্পনা করি, তাঁর মুখের আদল, গলার স্বর। আহ! আমার সঙ্গে তাঁর কেন দেখা হলো না!
ভালো লেগেছে যে অনেকেই এখনো পরিবার নিয়ে আসে পরিচিতদের কবরে ফুল দিতে। ইস্ট এশিয়ানদের দেখলাম কবরের ওপরে জাগতিক খাবারদাবার, লণ্ঠনও দিয়ে যেতে। কবরে থাকা মানুষটারও মনে হয় আমার মতো অন্ধকারের ভয় ছিল! ভিয়েতনামের এক ব্যক্তির কবরে দেখি পিৎজা দেওয়া—বেচারা পিৎজা খুব খেত মনে হয়। অনেকেই হয়তো হাসবে এঁদের এই কাজকারবার দেখে আমি ভেবেছি এঁরা এখনো কত অনুভব করে মরে যাওয়া স্বজনদের। এত বছর পরেও দেখতে আসার সময় প্রিয় খাবার, প্রিয় ফুল, প্রিয় পানীয় নিয়ে আসেন।
আমার কাছে এ ধরনের সেমিটারিগুলো একটা বিশাল উপন্যাসের মতো। অনেক চরিত্র। আগে-পরের, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন কালের—এঁদের একেকজন একেকটা কাহিনি। আমি এঁদের এপিটাফ পড়ি আর মনের মধ্যে কল্পনা করি আমি যেন একটা লাইভ ফিল্ম দেখছি, অমুক মানুষটা এই তারিখে জন্মাল, বড় হলো, এই তারিখে মরে গেল। মাঝখানে তার সঙ্গী কে হলো, ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতি কারা হোল (অনেকেই নামগুলো ও দিয়ে দেয় যে কারা কারা তাঁকে স্মরণ করে এই এপিটাফ লাগিয়েছে)।
মৃত মানুষের শহরে এসে বুঝলাম, মৃত্যুতেও জীবন থেকে কেউ পুরোপুরি সরে যায় না, পাথরের নিচে শুয়ে থেকেও কারও না কারও মনে সে ঠিকই থেকে যায়। এমনকি কোনো আগন্তুক ও তাঁকে নিয়ে চকিতে ভাবতে বসে, যেমনটা এই আমি করি মেলবোর্নের নানান সেমিটারিতে গিয়ে। ভালো থাকুন না-দেখা মানুষেরা! আবার দেখা হবে।
*শাহরিয়ার হায়দার, পিএইচডি গবেষক, মোনাশ ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া