দেশের জন্য হাহাকার করে মনটা

বিমানে ওঠার পরই আমার নাম হয়ে গেছে প্রবাসী কিংবা কামলা। তবে নিজের দেশকে ভালোভাবে চিনেছি প্রবাসে এসে। এখানে আসার পর দেশের অতি তুচ্ছ সব ঘটনাও অপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। মায়ের বকুনি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, মহল্লার দোকানে বসে চা খাওয়া, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা, দলবেঁধে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া, ভরা জ্যোৎস্না রাতে বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো, রাত জেগে ওয়াজ শোনা, পাড়াপড়শি মারা গেলে জানাজায় শরিক হওয়া—এসব তখন খুবই তুচ্ছ মনে হতো। কিন্তু প্রবাসে আসার পর এগুলোর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। একাকী সময় স্মৃতির খাতায় এই ক্ষুদ্র কর্মগুলো আমাকে আনন্দের মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে বেড়াই। নিজের দেশকে পৃথিবীর সেরা দেশ মনে হয়।

এখনো আমার মনে পড়ে বাঁধানো পুকুরঘাটে গোসল শেষে ঘরে ফেরার ছবি, মাঠের ধারে গবাদিপশু চরে বেড়ানো, রজনীগন্ধা ফুলের সুগন্ধ, সন্ধ্যায় হাঁস-মুরগির গৃহে প্রত্যাবর্তন। এই ক্ষুদ্র ব্যাপারগুলো দেশে থাকতে কখনো অনুভব করিনি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ এক অন্য রকম ভালো লাগা অনুভূতি, যে এই অনুভূতির আস্বাদ পায়নি, তার মতো হতভাগ্য বুঝি কেই নেই।

এখন রমজান মাস চলছে। পরিবারবিহীন একা একা সাহ্‌রি খাওয়া ইফতার করা কি যে কষ্ট! মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠি। কত কাল যে ঈদ উৎসব পরিবারের সঙ্গে উদ্‌যাপন করি না, মসজিদের আজান শুনি না, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতে ফুল নিয়ে শহীদদের সম্মান জানাই না, বৈশাখী প্রভাতে পাখির কলকূজন উপভোগ করি না, পিঁড়িতে বা মোড়ায় বসে গল্পগুজব করি না, কোরবানির গরু কিনতে গরুর হাটে যাই না। এসবই যেন এখন বিস্মৃত অতীত এক স্বপ্ন।

দেশের জন্য মনটা আজকাল কেমন-কেমন জানি করে। এ অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো না। আমার মনে হয়, যারা চিরকাল গ্রামে বসবাস করেন কিংবা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না তারা উপলব্ধি করতে পারবে না আমাদের অনুভূতি। তারা হয়তো ব্যঙ্গ করে বলবে, এতই যখন অনুভূতি, তাহলে দেশে ফিরে আসলেই হয়। তারা হয়তো জানে না প্রত্যেক প্রবাসী স্বপ্ন বুননের কারিগর, তারা সেই স্বপ্ন বুনতে বুনতেই দেখে কয়েক যুগ কেটে গেছে, তখন আর ফিরতে ইচ্ছে করে না।

যারা আত্মীয়স্বজনবিহীন একাকী প্রবাসে বাস করে তারা জানে বাংলাদেশের জন্য, প্রিয় সন্তানের জন্য, প্রিয়তমার জন্য, নিজের গ্রামের জন্য, দেশের প্রিয় আত্মীয়স্বজনের জন্য, নিজের পোষা প্রাণীর জন্য মনটা কী রকম হু হু করে।

ইদানীং পরিবার, আত্মীয়স্বজন, নিজ গৃহের জন্য মনটা বেশি রকম হাহাকার করছে। সব সময় ভাবি কবে যে এই প্রবাসজীবন থেকে মুক্তি পাব, সেখানে মায়ের হাতের রান্না খাব, নিস্তব্ধ অপরাহ্ণে বিস্তীর্ণ মাঠে একটু হাঁটাহাঁটি করব, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেব, প্রিয় আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কত কাল পর আবার দেখা হবে। এসব ভাবনা ধীরে ধীরে সে অনুভূত আনন্দের বন্যা আমার মনে কূল ভাসিয়ে দোলা দিয়ে যায়।

প্রায় দুই বছর বাংলাদেশে যাই না। দেশের জন্য মনটা উতলা হয়ে আছে। অফিস শেষে বাসায় ফিরে মনটা আরও বেশি রকম খারাপ হয়ে যায়। সবকিছুই কেমন লক্ষ্মীছাড়া উদাস ধু ধু প্রান্তর মনে হয়।

দেশে ফিরব ভাবলেই মনের মধ্যে অনুভূত আনন্দের বন্যা বয়ে চলে। সিঙ্গাপুরপ্রবাসী লেখক শরীফ ভাই সেদিন বললেন, প্রবাসীরা দেশে ছুটিতে যাওয়ার সময় তাঁর চোখে মুখে যেই আনন্দের ঝিলিক দেখা দেয়, তা যদি প্রিয়জনেরা অনুভব করতে পারতেন, তাহলে তাঁকে আর কখনই প্রবাসে আসতে দিতেন না!

*এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুরপ্রবাসী