চার কোনায় ভরা ভালোবাসা

মায়ের সঙ্গে লেখক মীর হাসিনা আক্তার। ছবি: মীর হাসিনা আক্তার
মায়ের সঙ্গে লেখক মীর হাসিনা আক্তার। ছবি: মীর হাসিনা আক্তার

মোবাইলে আজানের অ্যালার্টে ভেঙে গেল কাঁচা-পাকা তন্দ্রাটা। আর ঘুম-জোড়ানো আধখোলা চোখের সামনের দৃশ্যপট মুহূর্তে আমাকে টেনে আছড়ে ফেলল হাজার মাইল দূরের বাস্তবতায়। ইশ্‌! ছাদের ওপর থেকে হেডলাইট সাইজের টসটসে পেয়ারাটা ছিঁড়তে হাত বাড়িয়ে ছিলাম সবে। উফফ, স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে!, স্বপ্নের সঙ্গে তন্দ্রার সখ্য বোধ করি ঘুমের চেয়েও বেশি, একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে না হতেই চটপট হাজিরা দেয় আরেকজন।

সুন্দর স্বপ্ন থেকে বাস্তবে আছড়ে পড়ে, ভেতরকার আমিটা খানিকটা বিরক্ত সেই সঙ্গে বাহ্যিকভাবে শরীরটা তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করল, কুঞ্চিত কপাল আর ভারী দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরতেই চোখ আটকে গেল দেয়ালঘড়িতে, ছোট মাত্রার একটি ইলেকট্রিক শক খেলাম, যার ফলাফল অস্ফুট আর্তনাদ; ‘ওহ শিট! জামাই আসার সময় হয়ে গেছে।’ স্লিপিং মুডে থাকা শরীর মুহূর্তেই রিস্টার্ট নিয়ে নিল। বিছানা ছেড়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের সঙ্গে সামনে রাখা ট্রলি ব্যাগটার মুখোমুখি চুম্বনে ঘটল বিপত্তি। ভেতর থেকে উঠে আসা চাপা গোঙানিটা দুই ঠোঁট চেপে ভেতরে পাঠিয়ে, বুড়ো আঙুল চেপে মেঝেতে বসে পড়লাম তৎক্ষণাৎ। পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে মনোযোগ আটকে গেল সামনে রাখা ট্রলি ব্যাগগুলোতে, ছাই রঙের সাধারণ দুটি ট্রলি ব্যাগ যার ভেতরটা অসাধারণ মহামূল্যবান সম্পদে ঠাসা। যার পরতে পরতে আমার মায়ের গন্ধ আর বোনের হাতের ছোঁয়ায় ভরা। মাকে ছেড়ে এসেছি সপ্তাহ দু-এক হলো। কিন্তু মায়ের ছোঁয়ায় মোড়ানো ব্যাগগুলোকে চোখের আড়াল হতে দিইনি। নিজের অজান্তেই পা ছেড়ে হাত চলে গেল ব্যাগে আদর করার মতো আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম তাতে, ব্যথাটা কখন যে শিফট ডিলিট হয়ে গেল টেরই পেলাম না।

ব্যাগটা নামিয়ে লাল ফিতে বাঁধা চেইনটা টেনে খুলতেই খুব হালকা মিষ্টি একটা গন্ধ এসে লাগল নাকে, আমি যে গন্ধটার নাম দিয়েছি অক্সিজেন। মায়ের কাছ থেকে হাজার মাইল দূরে এই দেশটায় অস্তিত্বের অক্সিজেনের বড্ড অভাব আমার। ফুসফুস ভর্তি করে সেই অক্সিজেন নিলাম খানিক, যার সাইড ইফেক্ট হিসেবে চোখের ট্যাংকের ঢাকনা ঢিলে হয়ে গেল খানিকটা, অকারণে ঝাপসা হয়ে গেল দৃশ্যপট। কী সুন্দর! থরে থরে সাজানো বস্তু নামের ভালোবাসা। খুব সচেতনতায় হাত বুলিয়ে দিই সেই ভালোবাসায় আর অসচেতনতায় যোগ হতে থাকে এক-দুই ফোঁটা নোনতা জল। ভালোবাসা বড্ড অদ্ভুত এক অনুভূতি, যার ধরনটা অনেকটা পানির মতো। যার নিজস্ব আকার হয় না, যেখানে রাখা হয়, তার আকার ধারণ করে আর অবস্থার ভিন্নতায় যা হয়ে যায় কঠিন, আবার কখনোবা বায়বীয়। সবচেয়ে বড় কথা, যা ছাড়া বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। ভালোবাসাকে পানির এই সূত্রে ফেললে, আমি আমার মাকে ‘পানির’ মতো ভালোবাসি। বহুদূরে থাকা তৃষ্ণার্ত আমার কাছে চার কোনার এই ট্রলি ব্যাগভর্তি জিনিসগুলো অনেকটা এক আঁজলা ঠান্ডা পানির মতো, যা খানিকটা তৃষ্ণা নিবারণ করলেও বাড়িয়ে দিই তার কয়েক গুণ।

সময়ের হাত ধরে বয়সের আঁচড়ে পরিবর্তিত হয় মানুষগুলো, পরিবর্তন আসে ভালোবাসার ধরনে, প্রকাশে পায় ভিন্নতা। কিন্তু ভালোবাসা নামের অতি প্রাচীন অনুভূতি থেকে যায় ঠিক আগের মতো। আমার বর্তমানের অনুভূতি আর দৃশ্যপট হয়তো আমার মায়ের ফেলে আসা কোনো অতীতের সঙ্গে মিলে যাবে অনেকটা। আমার বাবার কর্মস্থল ঢাকায় হওয়ায় বিয়ের সুবাদে সেই ১৫ বছর বয়সে নানাবাড়ি সন্দ্বীপ ছেড়ে চলে আসতে হয় আমার মাকে। তখন থেকে মায়ের কাছে ফেরা যেন অনেকটা মরীচিকার মতো হয়ে যায় তার কাছে; আমাদের স্কুল, আব্বুর ছুটি, খালি বাড়ি...হাজারটা অজুহাতে ঘরে ফেরার স্বপ্ন তার কাছে স্বপ্নই থেকে যেত। সংসার নামের সুপারগ্লুতে আটকে পড়া আমার মা দু-এক বছর পর ১৫-২০ দিনের জন্য ছোটাতে পারতেন সেই আঠা। চিঠি লেখার সেই যুগে মাকে দেখার কঠিন এক আকুলতা আমি দেখেছিলাম আমার মায়ের চোখেমুখে। বাড়ি যাওয়ার বছর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা আমাদের চেয়ে তার বেশি বৈ কম ছিল না। ট্রলি ব্যাগ ওই সময়টাতে আমি দেখিনি ওটা কাপড়ের ব্যাগ আর ব্রিফকেসের যুগ। গাঢ় নেভিব্লু রঙের বেশ বড়সড় একটা ব্রিফকেস ছিল তার, যার ভেতরটা সোনালি রঙের কাপড়ের কুঁচি দেওয়া নকশা করা, সৌদি থেকে আমার এক কাকার আনা। বাড়িতে যাওয়ার দুই মাস আগে থেকেই বেশ সাজসাজ রব পড়ে যেত সেই ব্রিফকেসের ভেতর। আমার মা খুব যত্ন করে গোছাত সব; নানা ভাইয়ের পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে তার পছন্দের আতর, নানুর শাড়ি তার সঙ্গে রং মেলানো ব্লাউজের কাপড়, মামার লুঙ্গি, মামাতো বোনের নেলপালিশ, টাইগার বাম, কী ছিল না তাতে? সবার জন্য কিছু না কিছু জিনিসের নাম করে অনেকখানি ভালোবাসা নিয়ে যেত আমার মা। চার কোনার সীমাবদ্ধ জায়গায় অধিক ভালোবাসা জড়ো হওয়ায় বেশির ভাগ সময় আমাদের নিজেদের জিনিসপত্র রাখার জায়গা হতো না, আর তাতে জারপরনাই বিরক্ত হতাম আমরা ভাইবোনেরা। ছুটি শেষে ভালোবাসা বিলিয়ে নানু বাড়ি থেকে ফেরার আগে চার কোনার সেই ব্রিফকেস আবার ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন আমার নানু। চালের গুঁড়ি, শুকনা মরিচ, খেতের বাদাম, লইটা শুঁটকি, নারকেলের চিড়া, পাকন পিঠা আর কত শত কিছুতে ভরে টইটম্বুর হয়ে যেত সেই ব্যাগ, আর বরাবরের মতোই জায়গা মেলা কঠিন হয়ে যেত আমাদের জিনিসপত্র রাখার।

সময়ের ঘূর্ণমান চক্রে আমার মা আজ তার মায়ের ভূমিকায় আর তার চরিত্রে আমি বর্তমান। দেশে যাওয়ার আগে খুব যত্ন করে কেনা ভালোবাসা খুব ঠাসাঠাসি করে আঁটকে ছিলাম চার কোনার ট্রলিতে। শেষ অবধি নিজের জিনিসপত্র নেওয়ার জায়গা ছিল না তাতে। আর ফেরার আগে ভালোবাসা বিলিয়ে প্রায় শূন্য আমার ব্যাগ দেখি ওজনের বাঁধাধরা গণ্ডি বাড়াবাড়ি করে পার করেছে। খুঁজতে গিয়ে দেখি; যত্ন করে বানানো বরইয়ের আচার, আমের আচার, আমসত্ত্ব, বিছানার চাদর, শুকনা মরিচ, শাড়ি, পিঠার ছাঁচ, কী নেই তাতে! আমার মায়ের পানির মতো ভালোবাসায় আমার ব্যাগের চারকোনা ভরে টইটম্বুর। আর এদিকে ট্রলি জড়িয়ে ধরা আমার চোখের টইটম্বুর নদীও বাঁধ ভেঙেছে। ভালোবাসার হাত ধরে বিরহের নদীতে পিছলে পড়া আমি ততক্ষণে সাঁতার ভুলে ডুবতে বসেছি। হঠাৎ ডোরবেলের টিংটং শব্দ জোর করে টেনে আনে বাস্তবতা। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ উঠিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আপনা-আপনি জিহ্বায় চিমটি কাটে দাঁত, ‘ইশ্‌! আজকেও রান্নাটা হয় নাই...।’

*মীর হাসিনা আক্তার, উড-সাইড, নিউইয়র্ক