চোখের জলে প্রবাসে ইফতার

মো. আবদুল কাদের।
মো. আবদুল কাদের।

রহমত, বরকত আর নাজাতের মাধ্যমেই আসে মুসলিম বিশ্বের ঘরে ঘরে মাহে রমজানের আওয়াজ। সারা দিন রোজা রাখার পর পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের না পেলেই একা একা সারতে হয় আমার ইফতার। সাহ্‌রিটাও ঠিক একই রকম। আমার কর্মস্থলে আমি একজনই কেবল তাদের বিদেশি স্টাফ। তাই মালিকপক্ষ আমাকে তার একটি পুরোনো ফ্ল্যাটে থাকার জায়গা করে দেয়। ওই ফ্ল্যাটে রান্নার সব সরঞ্জামও রয়েছে। সেই পুরো একটি ফ্ল্যাটজুড়ে কেবল আমারই বসবাস। বাকি স্টাফরা স্থানীয় নাগরিক হওয়াতে তাঁরা তাঁদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন।

তাই আমার বেলায় প্রবাসে ইফতারের আনন্দটা কেন জানি আলাদা। পরিবার-পরিজনের সুখের খোঁজে নিজ গৃহ ছেড়ে আজ পরবাসী হয়েছি।

দ্বিতীয় রমজানে অফিস শেষ করে বাইরে অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি বন্ধ হলেই কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে নিজ হাতে ইফতার তৈরি করব, কিন্তু বৃষ্টি যেন থামছেই না। কিছুক্ষণ পর দেখি অফিস থেকে আমার এক স্থানীয় সহকর্মী বের হয়ে এলে আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাতে জিজ্ঞেস করল বাসায় ফিরছি না কেন? তখন আমি বললাম, বৃষ্টি বন্ধ হলে ইফতার কিনতে দোকানে যাব। তখন সে আমাকে বলল, আজ যেভাবে বৃষ্টি নামছে মনে হয় না থামবে বরং চলো আমি তোমাকে আমার গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিই। তখন বাধ্য হয়ে আমি তার প্রাইভেট কারে উঠি। কিছুক্ষণ পর ইফতার কেনার জন্য তার গাড়ি থেকে নেমে তাকে বিদায় জানাতে সে আমাকে বলে তুমি তোমার ইফতারসামগ্রী কিনে না-ও তারপর আমি তোমাকে বাসায় নামিয়ে আমি বাসায় ফিরব।

পরক্ষণে আমি ইফতার কিনে আবারও তার গাড়িতে উঠলাম এবং সে আমাকে জিজ্ঞেস করল বাসায় একা একা ইফতার করতে খারাপ লাগে না? বললাম, আজ তুমি আমার সঙ্গে ইফতার করো, ভালো লাগবে। তখন সে বলে, তার বাসায় তার মা-বাবা, ভাইবোন সবাই ইফতারি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন যদি আমি তোমার সঙ্গে এখানে ইফতারি সেরে নিই তাহলে মা-বাবা মনে কষ্ট পাবেন।

তার মুখ থেকে এ কথাগুলো শোনার পর হঠাৎ করে চোখের জ্বল যেন কোনোভাবেই থামাতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে তাকে বিদায় দিয়ে বাসায় এসে ইচ্ছে মতো কাঁদলাম। আর ভাবতে লাগলাম আমিও তো একটি সময় মা বাবার সঙ্গে ইফতার করেছিলাম। সে সময় আমার নিজেকে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ ও হতভাগা সন্তান। যে সন্তান গর্ভধারিণী মা বেঁচে থাকতেও তার হাতের ছোঁয়া, আদর ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত। যে সন্তান স্বাধীন সার্বভৌম দেশ থাকতেও তার বুকে নিরাপদ আশ্রয় ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত।

ভাবনার একপর্যায়ে নিজেরই মনের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম নিল, প্রবাসী না হয়ে আজ যদি আমিও নিজ দেশে মা-বাবার সঙ্গে রমজানের সিয়াম সাধনা করতাম, তাহলে তো হয়তো আজ আমার সহকর্মীর মায়ের মতো আজ আমার মা-ও ইফতারি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। এরপরও কষ্টের মধ্যে রোজা রেখে দেশের জন্য দোয়া করি, যাতে করে মাতৃভূমির সবাইকে আল্লাহ ভালো রাখেন এবং সিয়ামসাধনা করার তৌফিক দান করেন।

*মো. আবদুল কাদের, মালয়েশিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক